উপর থেকে তাকালেই চারদিকে বন আর বন। বনের খুব কাছে বিশাল সমুদ্র। প্রাকৃতিক এই নজরকাড়া দৃশ্য কক্সবাজারের সমুদ্র তীরবর্তী হিমছড়ি পর্বতমালার শুকনাছড়ি পাহাড়ি এলাকার। জীববৈচিত্রের আধার এই ঘন জঙ্গল ধ্বংস করেই এখানে গড়ে তোলার কথা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। যার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭০০ একর বন।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দেয়। বন বিভাগ এই জমি তাদের বলে দাবি করে আসছিল।
পাশাপাশি ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে একটি রিট মামলাও হাইকোর্টে দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ এ বন্দোবস্তের বিষয়ে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন যা আপীল বিভাগে বহাল রয়েছে। এছাড়া শুকনাছড়ি পাহাড়ে সিভিল সার্ভিস একাডেমি নির্মাণের বিরোধিতা করে শুরু করেই কক্সবাজারের পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করে আসছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার অবশেষে বাতিল করে ৭০০ একর বনভূমির বরাদ্দ। বিপন্ন এশীয় বুনো হাতিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বুনো প্রাণীর নিরাপদ বসতি এই ঝিলংজা বনভূমি।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন, এখানে পশু-পাখিসহ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ফিরিয়ে আনতে কাজ করা হবে, নিরাপত্তার সাথে যাতে বন্যপ্রাণী বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। বনের যেসব জায়গায় খালি হয়েছে বা বনায়ন উপযোগী সেগুলোতে বনায়ন করা হবে। এছাড়াও ওই বনের যেসব অংশ জবরদখল করা হয়েছে সেগুলো উচ্ছেদ করে পুনরায় বনায়ন করা হবে।
৭শ একর বনভূমির বিভিন্ন স্থানে অন্তত হাজার খানেক বসতি রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের। সেখানকার বাসিন্দা রোকিয়া বলেন, আমরাও সরে যেতে চাই, তবে তা সরকারিভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে।
পরিবেশকর্মী কলিম উল্লাহ প্রত্যাশা করে বলেন, প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়, উন্নয়ন হোক প্রকৃতি রক্ষার মধ্য দিয়ে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন’ স্থাপনের জন্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের এই ভূমি মাত্র ১ লাখ টাকার প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দেয় তৎকালীন সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌজার বিএস ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত বিএস ২৫০০১ নম্বর দাগের ‘পাহাড়’ শ্রেণির ৪০০ একর ও বিএস ২৫০১০ নম্বর দাগের ‘ছড়া’ শ্রেণির ৩০০ একর মোট ৭০০ একর জমি রক্ষিত বনের গেজেটভুক্ত হওয়ায় উক্ত বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা একটি আধা-সরকারি পত্র প্রেরণ করেন। উপদেষ্টার পাঠানো আধা সরকারি পত্রে বলা হয়, বন্দোবস্তকৃত এলাকা ১৯৩৫ সাল থেকে বন আইন ১৯২৭ এর ২৯ ধারার আওতায় রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত। এই ২১৪৫.০২ একর ভূমির অংশে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং হাতি, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ সালে এই বনভূমিতে বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রেকর্ডে ‘রক্ষিত বন’ উল্লেখ না থাকায় বন বিভাগ এ বিষয়ে মামলা করে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ করতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘রক্ষিত বনভূমির’ প্রায় ৫ হাজার কোটি মূল্যের ৭শ একর ভূমি মাত্র ১ লাখ টাকার প্রতীকি মূল্যে বরাদ্দ দেয় তৎকালীন সরকার।
উল্লেখ্য, গেলো ১০ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে উল্লিখিত বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণপূর্বক ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বনভূমির এ বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
পাঠকের মতামত: