নির্বাচনি সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এজন্য সবার কাছে প্রয়োজনীয় সময় চেয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন; সবাইকে বিনাদ্বিধায় মনের কথা তুলে ধরার আহ্বান করেছেন।
রোববার সন্ধ্যা ৭টায় অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। তার এ ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন-বিটিভিসহ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
জনগণকে দেশের মালিক হিসেবে তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন সংস্কার কমিশনে খোলামেলাভাবে তাদের মতামত তুলে ধরার আহ্বান করেছেন। বলেছেন, “আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন আপনি কী চান। কীভাবে চান।
”নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন।”
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা’ শুরু করার কথা আবারও তুলে ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস। বলেন, “এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তারজন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের দায়িত্বে থাকার এই তিন মাসের মধ্যে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া ৩৪ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বরোপ করেন। তিনি কোন প্রেক্ষিতে সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার কেন জরুরি সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। একই সঙ্গে এমন একটা নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা তিনি বলেন যা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে।
তিনি বলেন, ”আমরা চাইব, আমরা যেন এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি।“
সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিকে নীতির কাঠামোয় আনার জন্য এবং রাজনীতির জন্য নতুন পরিবেশ সৃষ্টির নিবিড় আকাঙ্ক্ষা থেকে। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত নির্বাচনসহ সংস্কার নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচন কবে হবে এই প্রশ্ন আপনাদের সবার মনেই আছে। আমাদের মনেও সারাক্ষণ আছে। আপনারা লক্ষ্য করেছেন নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তারপর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সমস্ত দায়িত্ব তাদের উপর বর্তাবে।“
সরকারের ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথাও ভাবতে হচ্ছে। আপনারা সবাই জানেন, আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত নিয়ে যাচ্ছি। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব মতামত অনেকাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিটি মতামত সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
”আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় বসব। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।”
তবে সংস্কারের এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সময় পাবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করব।”
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
এর তিন দিন পর ৮ অগাস্ট নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। সেদিন জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। রোববার ১০০ দিন পূর্তিতে চতুর্থ দফায় ভাষণ দেন তিনি।
নির্বাচনসহ সংস্কারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদেরকে এ ম্যান্ডেট দিয়েছেন। যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম তারা ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।”
এসব প্ল্যাটফর্মে সবাইকে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন নিয়ে আপনাদের সকল বক্তব্য বিনাদ্বিধায় বলতে থাকুন। সবার মনের কথা তুলে ধরুন। আমার অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন।
”সংস্কার হল জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনী শক্তি। সংস্কার জাতিকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।”
নির্বাচন আয়োজনে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে রাজনৈতিক দল ও সবার মতামত নিয়ে নির্বাচনি আইন সংশোধন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
পাঠকের মতামত: