টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সব নদী-খালের পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত আড়াই লাখ মানুষ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, সদর ও ঈদগাঁও উপজেলার বাসিন্দারা।
বিভিন্ন উপজেলার অভ্যন্তরীন সড়কসহ পানিতে ডুবে গেছে সহাসড়কও। এতে দুর্ঘটনা এড়াতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি গর্জনিয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দক্ষিণ মিঠাছড়ি কঠিরমাথা এলাকায় সড়কে কোমর পরিমাণ পানি থাকায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে নদীর পানিতে ডুবে একজনসহ পৃথক স্থানে পাহাড়ধসে মোট পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন শিশু ও একজন নারী রয়েছে। সোমবার (৭ আগস্ট) বিকেলে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও চকরিয়া উপজেলার পূর্ব ভিলিজার পাড়া এবং মাতামুহুরী নদীর লক্ষ্যরচর মোহনায় এসব ঘটনা ঘটে।
মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) সকালে চট্টগ্রাম চান্দনাইশ এলাকার সড়কে পানিতে টইটুম্বুর দেখা গেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের ওপর দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি বয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। তাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল বন্ধ করা হয়।
সরেজমিন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়া-পেকুয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের খামার। এ ছাড়া বন্যার কারণে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ গবাদিপশুসহ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বন্যার্তদের অনেকে গবাদিপশুসহ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। গত সোমবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। বন্যায় জেলার সাত উপজেলার প্রায় ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়েছে ১৫টি গ্রাম।
চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় বন্যার ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। চকরিয়া উপজেলার মানিকপুর এলাকার কথা হয় ষাটোর্ধ্ব আব্দর জব্বারের সঙ্গে। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ডিঙিনৌকায় কাঁথা–বালিশ, লাকড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, রান্নার জন্য কাটা তরকারিসহ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন। গতকাল বেলা ১১ তার ঘরে পানি ওঠায় জিনিসপত্র নিয়ে চকরিয়ার পৌর এলাকার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার সদরের ১০ গ্রাম, মহেশখালীর ১৫, ঈদগাঁওর ১২ কুতুবদিয়ার ১৫, চকরিয়ার ২০, উখিয়ার ১০, রামুর ২০, পেকয়ার ১৫ ও টেকনাফের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে কৃষি ফসল ও চিংড়ি ঘের।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, রামু সদর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ৯০ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে এসব এলাকার দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মাতামুহুরী নদীর কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারে টানা ভারী বর্ষণ হচ্ছে। একইসঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে নেমে আসছে।
সোমবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের স্রোত আরও বেড়েছে। পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, হারবাং, পুর্ববড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড়ো ভেওলা, চিরিঙ্গা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, ফাসিয়াখালী চকরিয়া পৌরসভা, পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ার, রাজারকুল ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রামে বন্যার পানি ঢুকেছে। এসব গ্রামের সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাজারে পানি উঠেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন ওই এলাকার বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে আশ্রয়ের জন্য অনেকে ছোটাছুটি করছেন।
রামু উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরোয়ার কাজল জানান, বাঁকখালী নদীর পানি উপচে রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল ও ফতেখাঁরকুলে ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকছে। দক্ষিণ মিঠাছড়ি কাঠিরমাথায় পানি জমে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু জানান, প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ধলঘাটার কয়েকটি গ্রামের সড়কের ওপর পানি ওঠে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ধানের বীজতলা, পানের বরজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন টিপু সুলতান বলেন, ঝিলংজার দক্ষিণ খরুলিয়া, পূর্ব মোক্তার কুল, পশ্চিম মোক্তার কুল, মহুরি পাড়া, চান্দেরপাড়া, ঘাটপাড়া, কোনার পাড়া, নয়া পাড়াসহ বাঁকখালী নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যার পানি ডুকে পড়েছে। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্ব প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।
রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির যুবক রোনাদ বলেন, গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি ঘরে পানি উঠে পড়েছে। গত ৪/৫ বছরে এমন পানি দেখিনি। শুধু আমার বাড়িতে না আমার এলাকা উমখালীর সবার বাড়িতেই পানি উঠেছে। এখন আমরা কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।
রোনাদ আরোও জানান, সন্ধ্যার আগেই কিছু জিনিস নিয়ে তার এলাকার অনেকে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্রসহ বাকি সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
সদরের পূর্ব মোক্তারকুল এলাকার বাসিন্দা ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক আমিন বলেন, ২০১৪ সালের পরে তারা কখনো এত পানি দেখেননি। গত ৮ বছরে যেসব জায়গায় পানি ওঠেনি, সেসব জায়গায়ও এবার পানি উঠেছে। যেভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় পানি বাড়ছে,
পাঠকের মতামত: