কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গা দুর্ভোগ: প্রশ্নবিদ্ধ বৈশ্বিক উদ্যোগ

 

বিশ্ব শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানায়, দুই হাজার ৭০০ জন রোহিঙ্গা কাঠের নৌকায় সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে গেছে। তারা আরো বলেছে যে, নৌকায় সমুদ্রপথ অতিক্রম করার সময় শিশু ও নারীসহ প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা সমুদ্রে সলিল সমাধি হয়েছে।

সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে শিশু-নারীসহ অনেক রোহিঙ্গা মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং এ ঘটনা অহরহ ঘটছে। তাদের বক্তব্য মতে উন্নতজীবন যাপনের জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অতিসংগোপনে নারী-পুরুষসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে কাঠের নৌকায় বা বাতাসে ফুলানো বেলুনের নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়ার জন্য জীবনবাজি রাখছে।

নৌকাগুলোতে নেই কোনো ছাদ বা বৃষ্টি বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে যাত্রীদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থা। সরকার ও জাতিসঙ্ঘ বলছে রোহিঙ্গাদের বাসস্থানসহ নিয়মিত ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। তারপরও তারা সলিল সমাধি হওয়ার কথা জেনেও কেন নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন?

মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ২০১৬ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে সপরিবারে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে জীবন রক্ষা করে। যদিও Convention Relating to the Status of Refugee ১৯৫১ এবং ১৯৬৭ সালে সম্পাদিত এর প্রটোকলে বাংলাদেশ স্বাক্ষরদাতা নয়, জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৫১ সালের কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকল মানতে নীতিগতভাবে বাধ্য। ওই ১৯৫১ সাল আর্টিকেলের ৩৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, গোষ্ঠীগত ভিন্নতা, জাতীয়তা, কোনো বিশেষ গ্রুপের সদস্যপদ গ্রহণ বা রাজনৈতিক কারণে কোনো ব্যক্তি বা নাগরিক নিজ রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জীবন বাঁচানোর জন্য নিজ রাষ্ট্র থেকে পালিয়ে অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে আশ্রয় গ্রহণকৃত রাষ্ট্র আশ্রয় প্রার্থীকে বিতাড়িত করতে পারবে না।’

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জাতিসঙ্ঘ সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। ফলে অনেকে মনে করেন যে, যেহেতু বাংলাদেশ ১৯৫১ কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের স্বাক্ষরদাতা নয় সেহেতু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। ওই কনভেনশন ও প্রটোকল জাতিসঙ্ঘ প্রণীত আন্তর্জাতিক সনদ। ফলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করে জাতিসঙ্ঘের সনদ, সংবিধান ও মানবতার প্রতি বাংলাদেশ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;

(খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’

জাতিসঙ্ঘ প্রণীত আন্তর্জাতিক সনদ ÔThe Universal Declaration of Human Rights, 1948Õ এর ১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জীবনপ্রাণ রক্ষার জন্য যেকোনো ব্যক্তির অন্য রাষ্ট্রের আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে।

মিয়ানমারের অন্যতম প্রদেশ আরাকানের আদি নাম হলো ‘রোহাঙ্গ’। যেখানের ৪০% অধিবাসীই মুসলমান। ইতিহাসবিদদের ভাষ্য মতে, ত্রয়োদশ শতকে আরব বণিকরা ব্যবসা করতে এসে বার্মার আরাকান ও চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করে, বংশানুক্রমে তারা এখন নিজ নিজ এলাকাই বসবাস করে আসছে। রোহাঙ্গ প্রদেশের নামানুসারে তারা এখন রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। মিয়ানমারে ১০০০ বছর বসবাস করার পরও রোহিঙ্গা এখন ঘরকা না ঘাটকা। ‘নয়াপড়া’ (কক্সবাজার) নামক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থানকারী এক শিক্ষিত যুবকের ভাষ্যমতে ‘I was born in Burma, but Burmese Government says I do not belong there. I grew up in Bangladesh, but the Bangladesh Government says I can not stay here. As a Rohinga I feel I am caught between a crocodile and a snake’ (সূত্র: International Law of Refugees, পৃষ্ঠা-১৫৫)।

১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়। যখন বার্মিজ সরকার রাখাইনের বিরোধী গ্রুপ বিশেষ করে আরাকান কমিউনিস্ট পার্টি, আরাকান ইনডিপেন্ডেন্ট অরগানাইজেশন,আরাকান ন্যাশনাল ফ্রন্ট, রোহিঙ্গা গ্যারিলাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে, হত্যা, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি করার কারণে ওই সময় প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ওই সময়ে সমস্যার একটু হালকা সমাধান হলেও ২০১৬ সালে এ সমস্যা আবার প্রকট আকার ধারণ করে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে তারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমান রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। বিশেষজ্ঞদের মতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর ৩০ হাজার শিশু জন্ম গ্রহণ করছে। পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের জন্য বহন-অযোগ্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সবাই চায় তার নিজ দেশে অবস্থান করতে, দুঃখ কষ্ট হলেও একজন মানুষের প্রিয়স্থান হলো তার মাতৃভূমি। কবি ও সাহিত্যিক Euripides বলেছেন ‘There is no greater Sorrow on earth than the loss of once native land’ অর্থাৎ তার চেয়ে অধিক দুঃখি কেউ নেই, যার স্থান নিজের দেশে হয় না।

জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থী সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের প্রধান সংস্থা হিসেবে আইআরো এর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমন : মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণার ১৪(১) নং অধ্যায়, নিপীড়নের সাথে ‘আশ্রয়’ এর সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক আশ্রয়ের প্রভাব বিবেচনায় এনে এর ক্ষমতার ক্ষেত্র এবং ব্যাপ্তি নিচে সম্পূর্ণরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। এভাবে শরণার্থীর আন্তর্জাতিক আইনি ধারণার ভিত্তি চুক্তি, জাতীয় এবং জাতিসঙ্ঘের রীতি এবং ইউএনএইচসিআর এর সংবিধানে দেখা যায়।

শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা এবং শরণার্থী সমস্যার স্থানীয় সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠা করে। ইউএনএইচসিআরের সংবিধান অনুযায়ী-এর কর্মকাণ্ড হতে হবে সম্পূর্ণরূপে অরাজনৈতিক, মানবিক এবং সামাজিক এবং এর কর্মকাণ্ড শরণার্থী সংশ্লিষ্ট হবে। সংবিধান মোতাবেক আগে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি এবং কর্মসূচির আওতায় শরণার্থীরা প্রথমে ইউএনএইচসিআর এর ক্ষমতার মধ্যে আসবে। ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারির আগে যেসব লোক তাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল এবং নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে তারা দেশে যেতে পারে না কিংবা ইচ্ছুক নয় তাদেরকে ইউএনএইচসিআর এ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেসব লোক তার নিজ দেশ কিংবা কোনো দেশের অভ্যাসগত বাসিন্দা হলে যদি সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয় এবং তারা যদি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে সে দেশে যেতে ইচ্ছুক না হয় তাহলে তারা ইউএনএইচসিআর-এর সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরিউক্ত বিবরণী সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। এতে কোনো সাময়িক কিংবা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা থাকবে না। শরণার্থীদের ক্ষেত্রে বাস্তব কিংবা ভাবাদর্শগত মাপকাঠি তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। বর্ণিত কারণের মধ্যে নির্যাতনের ভয় রয়েছে তা শরণার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যা রোহিঙ্গারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

কারা জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা এবং সহযোগিতা পাবে তা নির্ধারণের জন্য শরর্ণার্থীর সংজ্ঞায় একটি সমালোচনামূলক বিষয় রয়েছে। এটা তাদের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুরক্ষা অভাবের জন্য। সরকার সাধারণ বিদেশী এবং শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য করে। এই অভাব পূরণের জন্য উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার লক্ষ্য হবে জীবন, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার অধিকারসহ শরণার্থীদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা। একই সাথে সুরক্ষা কর্মকাণ্ড কেবল শরণার্থীর বিশেষ ইস্যুকেন্দ্রিক হবে। উদাহরণস্বরূপ এটা নিশ্চিত করতে হবে, যে দেশে বিপদগ্রস্ত সে দেশে শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো যাবে না। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শরণার্থীর একটি জ্ঞাত প্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকার থাকবে এবং প্রত্যেক শরণার্থী স্বীকার করবে যে, আশ্রয় মঞ্জুর করা হয়েছে, বিতাড়ন রোধ করা হয়েছে এবং ভ্রমণ এবং পরিচয় সংক্রান্ত কাগজপত্র ইস্যু করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু অধিক্ষেত্রের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু অধিক্ষেত্র ভিত্তি থাকতে হবে বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে করা হয় যা আশ্রয়ের বিরোধী কিংবা যে আইন, বিধি কিংবা রীতিনীতি সংক্ষিপ্ত খারিজভিত্তিক হতে পারে।

চাঁদ, মঙ্গল প্রভৃতি উপগ্রহ অনুসন্ধান শেষ করে বিশ্ব নেতারা এখন মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ তল্লাশি করছেন, নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় পুরো নভোমণ্ডল চষে বেড়াচ্ছেন, সাগর, মহাসাগরের তলায় কী আছে তা অনুসন্ধান করছেন, নিজ নিজ রাষ্ট্রকে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার নেশায় জনগণের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে মরণাস্ত্র তৈরি করছেন বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন বাজেট দিয়ে, তৈরি হচ্ছে জীবাণু বোমা, মানবতার কথা প্রচার করার জন্য ছাপানো হচ্ছে বিপুল অর্থ, অথচ মিয়ানমারের অবহেলিত রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই, এ মর্মে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত অমানবিক এবং প্রশ্নবিদ্ধ। রোহিঙ্গারা যেহেতু মুসলমান সেহেতু বিশ্ব যাদের দখলে তাদের নিকট থেকেও কার্যকর কোনো সহানুভূতি ও সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

পাঠকের মতামত: