কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

রিমান্ড ও জবানবন্দিতে আইনজীবী উপস্থিতি দরকার?

ইব্রাহিম খলিল::

গত চার জুলাই পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী নিখোঁজ হয়। গত ছয় আগস্ট নিখোঁজ স্কুলছাত্রীর বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব ও খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। স্বীকারোক্তিতে তারা বলে, তারা ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।

জবানবন্দি নেয়ার পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু ২৩ আগস্ট ওই ছাত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, আসামিরা কীভাবে ধর্ষণ ও হত্যা সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি দিয়েছে, যেখানে ওই ছাত্রী অক্ষত অবস্থায় ফেরত এসেছে। পরে অবশ্য আসামীরা স্বীকারও করে যে, পুলিশের ক্রয়ফায়ারের হুমকিতে তারা মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছে।

এ ঘটনায় গত ২৪ আগস্ট ধর্ষণের পর নদীতে মরদেহ ফেলে দেয়া স্কুলছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তনের খবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এ খবরে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। প্রশ্ন উঠে পুলিশের রিমান্ড এবং ম্যাজিস্ট্রেট এর জবান্দবন্দি রেকর্ড করার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে।

পত্রিকার প্রতিবেদন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির হাইকোর্টের নজরে আনেন। ২৭ আগস্ট শুনানি শেষে ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন হাইকোর্ট। মামলার নথিসহ হাজির হতে হবে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তাকে। গত বৃহস্পতিবার আদালতে রিমান্ড ও জবান্দবন্দির সময় আসামীপক্ষের আইনজীবী উপস্থিত থাকা কতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের দাবি সেটি সবিস্তরে উপস্থাপন করা হয়।

যখন পুলিশ রিমান্ডে নেয় এবং ম্যাজিস্ট্রেট যখন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করে- এই দুই ক্ষেত্রে আইনজীবী উপস্থিতি হলে অভিযুক্ত ব্যাক্তির জন্য এক ধরনের সেইফ গার্ড হয়। এই সেইফ গার্ডটি ইউএসএ তে আছে, ইউকে তে আছে, নেদারল্যান্ডে আছে, তিউনিশিয়ায় আছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আছে, সাউথ আফ্রিকায় আছে, ইন্ডিয়ায় আছে, এমনকি পাকিস্তানেও আছে।

ফলে আমাদের দেশেও এই সেইফ গার্ডটিকে ইন্ট্রোডিউস করাটা জরুরী আর সে জন্যই রিট আবেদনটি করা হয়েছে। এটি কোন ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে নয়, কোন জাজ বা ম্যাজিস্ট্রেট এর বিরুদ্ধে নয়, পুলিশের বিরুদ্ধে নয়, এটি সার্বিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য। কারণ ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে একজন ব্যাক্তির মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। যদি তাই হয়, এই জবানবন্দি গ্রহণের সময় আমরা যতটুকু ফেয়ারনেস বজায় রাখতে পারি, যতটুকু সম্ভব সেইফ গার্ড দিতে পারি ততটুকুই আমাদের বিচার ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের পথে সহায়ক হবে।

যখন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় মৃত মানুষ ফিরে এসেছে, অথচ জবানবন্দি রেকর্ড হয়ে গেছে আসামীরা বলছে সে মৃত তখন যিনি রেকর্ড ম্যাজিস্ট্রেট এবং যে পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে সবার বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। অথচ এখানে যদি আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় এবং পুরো বিষয়টির অডিও-ভিডিও রেকর্ড রাখতে পারি তাহলে অবশ্যই সার্বিকভাবে বিচার ব্যবস্থার প্রতি যে বিশ্বাস ও ভরসা সেটি আরও বৃদ্ধি পাবে। বিচার যদি বিশ্বাস, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপমুক্ত বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে হয় তবে সকলের পারপাস সার্ভ করবে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও রিমান্ড এবং জবানবন্দি রেকর্ডের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরী। এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় হয়েছিল, সেই রায় হয়ে যাবার পর তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করার পুরো সিস্টেমটাই চেঞ্জ করে দিয়েছে, এমনকি পুরো আইনটিই পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। সেই আইনে তারা বলেছে, যদি কোন অভিযুক্ত চায় সে আইনজীবী নিয়ে হাজির করতে পারবে এবং ওই জবান্দবন্দি গ্রহণের পুরো ঘটনার অডিও-ভিডিও রের্কড হবে। অডিও ভিডিও রেকর্ড এই জন্য রাখা হবে যে যদি কোন অভিযুক্ত ব্যাক্তি প্রশ্ন উত্থাপন করে যে আমি স্বেচ্ছায় জবানবন্দী দেই নাই বা আমাকে জোরপূর্বক হুমকির মাধ্যমে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে তবে ওই সময়ের অডিও বা ভিডিওটি আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দিলেই দেখা যাবে সত্যিকার অর্থে ঘটনা কি ঘটেছে। এটি বিচারকদের জন্যও সেইফ গার্ড হিসেবে কাজ করছে এবং সার্বিক বিচার ব্যবস্থা আরো উন্নতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।

আইনজীবী উপস্থিত থাকবে এটি আমাদের আইনে বলা নাই, উপস্থিত থাকতে পারবে না এটিও আমাদের আইনে বলা নাই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত প্রয়োগের এখানে সুযোগ আছে। আইনে যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলা থাকতো যে আইনজীবী উপস্থিত থাকতে পারবে না, তবে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত প্রয়োগের এখানে সুযোগ থাকতো না। যেহেতু আইনজীবী উপস্থিত থাকতে পারবে অথবা পারবেনা কোনটাই আইনে বলা নাই, সুতরাং আইনের ভাষায় এখানে একটি “ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা” সৃষ্টি হয়েছে। সেই শূন্য জায়গায় জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজম অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ইন্টারভিন করার সুযোগ আছে। ১৭টি মামলার নজির আছে যেখানে এই ভ্যাকুয়াম সিচুয়েশনে হাইকোর্ট ইন্টারভিন করেছে। প্রেসিডেনশিয়াল পারডন এর জাজমেন্ট এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আইনজীবী উপস্থিত থাকার কথা মানে আসামিপক্ষ নয় সরকার পক্ষের আইনজীবীও উপস্থিত থাকতে পারবে। তখন সেটার গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। সুতরাং এই ভ্যাকুয়ামের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে সিআরপিসি চেঞ্জ করা কোন দরকার নাই।

পাঠকের মতামত: