কক্সবাজার, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধুকে শেষ দেখা

ড. আনিসুজ্জামান

১৯৭৪ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে গেলাম। সভাকক্ষে এসে আসনগ্রহণের পরে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সভার পরে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করে যাই।

সভার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। তখন দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তার সংস্থান কীভাবে হবে, তার মনে সে চিন্তাও দেখা দিয়েছে। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন সেখানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা নাকি এমন রিপোর্ট লিখেছ যা ইমপ্লিমেন্ট করতে আমার পুরো বাজেট চলে যাবে।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনি কি ইন্টারিম রিপোর্ট পড়েছেন?’ তিনি বললেন, ‘রিপোর্ট পড়ার সময় কই আমার! সেক্রেটারিরা আমাকে যা বলেছে, আমি তার ভিত্তিতে বলছি। আমি বললাম, ‘আপনার কি মনে পড়ে কমিশন উদ্বোধন করার সময়ে আমি অর্থ-সংস্থানের বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, টাকা-পয়সার বিষয়ে আমরা যেন চিন্তা না করি। তবু আমরা চিন্তা করেছি। আপনাকে একটা উদাহরণ দিই। সব স্কুলে ভলো লাইব্রেরি থাকা উচিত। তবু বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আমরা বলেছি, ইউনিয়ন-পর্যায়ে এটা ভালো লাইব্রেরি থাকবে। সেখান থেকে স্কুলগুলো বই লেনদেন করবে। আদর্শ অবস্থার কথা ভাবলে আমরা অন্যরকম বলতাম।’

তিনি একটু ভাবলেন। আমি সেই অবকাশে জানতে চাইলাম, তিনি কেমন আছেন। কিছুকাল আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। আমার প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি খুব ভালো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে মস্কো থেকে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাইস-চ্যান্সেলর ঘেরাও হলে তাকে উদ্ধার করতে যেতে হয়। মস্কোতে থাকতে খবর পেলাম সূর্য সেন হলে সাতজন ছাত্র খুন হয়েছে। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এলাম’। বললাম, আপনি বিশ্রাম নিন না কেন? এখানে না পারেন সপ্তাহান্তে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যান।’ তিনি বললেন, ‘দেশে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম হবে না। যেখানে যাবো সেখানেই লোকজন ভিড় করবে।’ বললাম, ‘লোকজনকে দেখা দেবেন না।’ এবার তাঁর চোখে পানি এসে গেল। বললেন, ‘লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি না দিতে পারি, তাহলে আমার আর থাকলো কী?’

আমি এবারে অপ্রস্তুত হলাম।

এবারে তিনি কাজের কথা পাড়লেন। কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব ছাড়তে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা একজন শিক্ষাবিদকে এই পদে নিয়োগ দেবেন। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব হবে শিক্ষা-কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া। রিপোর্টের বিষয়টা আমার ভালো জানা আছে। তিনি আমাকে শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব দিতে চান এবং অবিলম্বে।

শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, প্রশাসনিক কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি সি এস পিদের অসহযোগিতার ভয় করছ! তুমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসতে পারবে, আমি সে-ব্যবস্থা করে দেবো।’ আমি প্রমাদ গুনলাম। বললাম, ‘আমি মাস্টারি করে এসেছি, তা-ই করতে চাই। সচিব হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ও-কাজ পারবো না।’

বঙ্গবন্ধু একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘আমার চারপাশে চোর-ডাকাত ভিড় করে আছে। আস্থা রাখতে পারি এমন সৎ লোক চাই কাজের জন্য। তাই তোমাকে বলছি। চোরদের থেকে রেহাই পেতে চাই।’ আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। বললাম, ‘লোকে তো তাই বলে, আপনার চারপাশে অনেক অসৎ লোক, আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।’

এবারে তিনি রাগ করলেন। বললেন, ‘কে বলে আমি ব্যবস্থা নেই না?’ কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট মহিলা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার নাম করে বললেন, ‘ওকে আমি এক্সপেল করিনি? কতকাল ধরে সে আওয়ামী লীগ করে এসেছে। তাকে যেদিন এক্সপেল করি সে-রাতে আমি ঠিকমতো ঘুমোতে পারিনি। ওর চেহারা, ওর মা-বাপের চেহারা, ওর ভাইবোনের চেহারা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।’

এরকম কোন সময়ে শিক্ষামন্ত্রী উঠে পড়লেন। তিনি লন্ডন যাচ্ছেন-তাকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। পরে শুনেছিলাম, লন্ডনে আমাদের দূতাবাসের কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন, আমি শিক্ষা-সচিব হতে যাচ্ছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘লন্ডনে গবেষণার জন্যে আমি বৃত্তি পেয়েছি। আমাকে এই কাজটি করতে দিন। ফিরে এসে আমি সরকারী কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।’

বঙ্গবন্ধু তবু বললেন, তখুনি ‘না’ না বলে ভাববার সময় নিতে। তার প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খানকে বলে দিলেন, পরদিন এই সময়ে আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসবো-সে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বেরিয়ে আমি সোজা এলাম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দপ্তরে। সেখানে অর্থসচিব মতিউল ইসলাম ছিলেন। তার উপস্থিতিতে আমি তাজউদ্দীনকে আদ্যোপান্ত জানালাম। অনুরোধ করলাম, তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।

তাজউদ্দীন বললেন, তিনি সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। কথাচ্ছলে বঙ্গবন্ধু যদি বিষয়টা উল্লেখ করেন, তাহলে তিনি হয়তো তাঁকে নিরস্ত করতে পারবেন। তবে কথা না তুললে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা তোলার সম্ভাবনাই বেশি। সত্যি তা ই হয়েছিল। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষা-সচিব করলে একজন ভালো শিক্ষক হারিয়ে মন্দ প্রশাসক পাওয়া যাবে, তাতে লাভ কী?

পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন, আমি মত পালটেছি কি না। আমি হাসলাম। বললাম, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগটা ছাড়তে চাই না। আপনি যদি অনুমতি দেন-।’

তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে কথা দিয়ে যাও, ফিরে এসে চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে। তখন আমি যা বলব, তা কিন্তু শুনতে হবে।’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। যা কখনো করিনি, এরপর আমি তাই করলাম। বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বিদেশ থেকে ফিরেই দেখা করবে আমার সঙ্গে।’ তারপর অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ততদিনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখবে কি না, কে জানে!’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি গলা এত নামিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো কথাটা বলেছিলেন। তাই আর কিছু বলতে চাইলাম না। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

পাঠকের মতামত: