কক্সবাজার, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ডিভোর্সি দম্পতির সন্তান কার কাছে থাকবে?

সমাজিক অবক্ষয়, অনৈতিকতা ও দায়িত্বহীনতার বিষাক্ত ছোবলে প্রতিনিয়ত ভাঙছে সুখের সংসার। হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদ। সৃষ্টি হচ্ছে নানান জটিলতা।

বিশেষত যখন দম্পতির দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তান থাকে। কখনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্তান নিয়ে শুরু হয় টানাহেঁচড়া। উভয়ে শিশুকে নিজের কাছে রাখতে দ্বারস্থ হন আদালতের। কখনো স্বামী-স্ত্রী কেউ-ই নিতে চান না শিশুর দায়িত্ব। এই অবস্থায় কখনো তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দিতে হয় সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ইসলামের বিধান কী?

বক্ষমাণ প্রবন্ধে তা আলোকপাত করা হবে, ইনশাআল্লাহ। এখানে দুটি বিষয়। একটি হলো সন্তানের অধিকার; আরেকটি হলো সন্তানের লালনপালন। একটি অপরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

সন্তানের অধিকার পিতার

সন্তানের জন্ম যদিও মাতৃগর্ভে, কিন্তু ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে সন্তানের বংশ সাব্যস্ত হয় পিতা থেকে এবং তার ওপর পিতার কর্তৃত্ব ও অধিকারই কার্যকর হয়। কোরআনের আয়াতও সেদিকে ইঙ্গিত করে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন :আর সন্তানের অধিকারী অর্থাত্, পিতার ওপর হলো সেই সমস্ত নারীর খোরপোষের দায়িত্ব, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। (সুরা বাকারা :২৩৩)। এখানে সরাসরি ‘পিতার ওপর’ না বলে ‘সন্তানের অধিকারীর ওপর’ বলে পিতাকে সন্তানের অধিকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সুতরাং ডিভোর্সি দম্পতির সন্তানের অধিকার ও কর্তৃত্বও পিতার। শরিয়তের নির্দেশনা হলো, যার ওপর যার অধিকার ও কর্তৃত্ব, সে তার ভরণপোষণ ও ব্যয়ভার বহন করবে। অর্থাত্, অধিকার ও দায়িত্ব পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ হিসাবে বিবাহবন্ধন বহাল থাকুক বা ডিভোর্স হয়ে যাক, সর্বাবস্থায় সন্তানের ভরণপোষণসহ যাবতীয় দায়দায়িত্ব পিতার ওপর অর্পিত হবে।

সন্তানকে দুগ্ধদান মায়ের দায়িত্ব

কিন্তু সন্তানকে দুগ্ধদান করা মায়ের ওপর ওয়াজিব। রোগ-ব্যাধি, অক্ষমতা বা শরিয়তসিদ্ধ কোনো কারণ ছাড়া সন্তানকে দুগ্ধদানে অস্বীকার করা গুনাহ। যতক্ষণ শিশুর মা স্বামীর বিবাহবন্ধনে বা ইদ্দত পালনরত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দুগ্ধদান বাবদ বিনিময় গ্রহণ করাও জায়েজ নেই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়ানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। (সুরা বাকারা :২৩৩)। কিন্তু মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে মায়ের ওপর দুগ্ধদানের দায়িত্ব থাকে না। এই অবস্থায় মায়ের জন্য দুগ্ধদানের বিনিময় দাবি করা জায়েজ এবং বিনিময় প্রদান করা স্বামীর দায়িত্ব।

আল্লাহ তায়ালা বলেন :আর যদি তোমরা কোনো ধাত্রীর দ্বারা নিজের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্তকৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও, তাতেও কোনো পাপ নেই। (সুরা বাকারা :২৩৩)

এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীর মাধ্যমে সন্তানকে দুধ পান করালে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিনিময় দেওয়া জায়েজ। ডিভোর্সি নারী যদিও সন্তানের গর্ভধারিণী মা, কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের কারণে সে এখন স্বামীর স্ত্রী নয়, তাই তার জন্য বিনিময় গ্রহণ জায়েজ।

সন্তানের লালনপালন

শরিয়তের আলোকে শিশুর মা সুস্থ-সবল হলে সন্তানের লালনপালন তার দায়িত্বে থাকবে। এমনকি মাতাপিতার বিবাহবিচ্ছেদ হলেও শিশুর মা শিশুর যত্ন ও লালনপালনে অন্যদের চেয়ে বেশি হকদার। নবিজির যুগে বিবাহবিচ্ছেদের পরে এক দম্পতির মধ্যে সন্তান নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সন্তানের পিতা মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে নিয়ে যেতে চাইলেন। মা চাইলেন সন্তানকে নিজের কাছে রাখবেন। পরে মহিলা নবিজিকে সার্বিক অবস্থা জানালেন। নবিজি সন্তানকে মায়ের কাছে রাখার হুকুম দিলেন।

হাদিসটি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন :একদা এক মহিলা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এই সন্তান আমার গর্ভজাত। সে আমার স্তনের দুধ পান করেছে এবং আমার কোল তার আশ্রয়স্থল। তার পিতা আমাকে তালাক দিয়েছে। এখন সে সন্তানটিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে বললেন, তুমি অন্যত্র বিয়ে না করা পর্যন্ত তুমিই তার অধিক হকদার। (সুনানে আবু দাউদ :২২৭৬)।

এই হাদিসের শেষাংশে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ডিভোর্সি নারী অন্য কোথাও বিয়ে করার আগ পর্যন্ত সন্তান লালনপালনে অগ্রাধিকার পাবেন। কিন্তু অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে সন্তান লালনপালনের অধিকার বাতিল হয়ে যাবে।

সন্তানের ভরণপোষণ

ডিভোর্সি দম্পতির সন্তান যার কাছেই লালিতপালিত হোক, সন্তানের যাবতীয় ব্যয়ভার পিতাই বহন করবেন। শিশু যদি ডিভোর্সি মায়ের কাছে লালিতপালিত হয়, তবু শিশুর খাদ্য, ওষুধপত্র, পোশাকসহ সার্বিক ব্যয় পিতা বহন করবেন। প্রসিদ্ধ ফিকাহগ্রন্থ হেদায়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এবং সন্তানের ভরণপোষণ পিতার দায়িত্বে।’

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া,

পাঠকের মতামত: