আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের ফাঁকে আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
সাংবাদিক নিক ক্লার্কের প্রশ্ন ছিল, ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি এবং সেখান থেকে তিনি যে বিবৃতি ও ঘোষণা দিচ্ছেন তা ইউনূস প্রশাসন কীভাবে দেখছে?
জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন- দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলায় আমরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি। এটা বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহায়ক হবে না। সুতরাং আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে আপনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, ভালো।
“তবে দয়া করে নিশ্চিত করুন যে- তিনি আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করবেন না। না হলে আমাদের আবার আপনাদের (ভারত) কাছেই অভিযোগ করতে হবে যে আপনি এমন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, যা আমাদের জন্য খারাপ। সুতরাং আমাদের উচিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে, বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এর সমাধান করা।”
সঞ্চালক বলেন, শেখ হাসিনা এখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখছেন।
তখন প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তিনি নিজেকে অনেক কিছুই বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। এমনকি ভারতও বলছে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী; সুতরাং তাকে আশ্রয় দিলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কিছুই বলছে না।”
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “হ্যাঁ, সেটার আইনগত প্রক্রিয়া চলছে এবং অভিযুক্ত হলে অবশ্যই তাকে প্রত্যর্পণের জন্য বলা হবে।”
নিক ক্লার্ক বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংখ্যালঘুর অধিকার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউনূস কীভাবে এই সংকট মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করছেন।
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা সংখ্যালঘুদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, দেখুন, আপনি দেশের নাগরিক। সংবিধান আপনাকে আপনার অধিকার, স্বাধীনতা, নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার, আপনার নিজের ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছে। এগুলো সংবিধানেই আছে।
“সুতরাং এটি আপনার (বাইরের দেশ) দিক থেকে আসা কিছু নয়। নাগরিকরা সংবিধানের দেওয়া অধিকার যাতে ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করাই সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।”
তখন সঞ্চালক বলেন, কিন্তু হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বেড়েছে বলে যে শোনা যাচ্ছে।
উত্তরে শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, “সহিংসতা বাড়েনি। আমি বলব সহিংসতা কমেছে। বিপ্লবের সময় থেকেই সহিংসতা শুরু হয়।
“এই কারণে নয় যে তারা হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তাদের বেশিরভাগই ছিল আওয়ামী লীগার।”
সঞ্চালক ক্লার্ক প্রশ্ন রাখেন, নির্বাচন আয়োজন করতে প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল; সেই মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে আলোচনা চলছে। বাস্তবতা কী?
জবাবে ইউনূস বলেন, “না, কেউ এটাকে সংক্ষিপ্ত সময় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে- এমনটা কখনো হয়নি। রাষ্ট্র সংস্কারকেই মূল দাবি বলা হচ্ছিল, কারণ ছাত্র আন্দোলনই হয়েছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। তাদের শব্দটা ‘নতুন বাংলাদেশ’। কেবল নির্বাচন করেই ‘নতুন বাংলাদেশ’ আসবে না।
“নির্বাচন আয়োজনের মানে রাজনীতির মাঠে পুরনো পদ্ধতির কেবলই পুনরাবৃত্তি। আমরা এসব থেকে পরিত্রাণ চাই। গোটা দেশের মানুষ এটাই চেয়েছিল- নতুন কিছু, পুরাতনের চেয়ে ভিন্ন কিছু। তার মানে অনেক কিছু।”
তিনি বলেন, “বিচার ব্যবস্থার সংস্কার দরকার, কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত বিচার বিভাগকে বিগত সরকার কব্জায় রেখেছিল। এর জন্য পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার।
“সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংবিধানের সংস্কার। আইনের মৌলিক বিষয়গুলো সংবিধানে আছে। তাহলে সংবিধান নতুন করে সাজাবেন কীভাবে? সে লক্ষ্যেই আমরা কমিশন গঠন করেছি।”
সঞ্চালক প্রশ্ন রাখেন- জনগণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নির্বাচন চায়- বিষয়টা কি তেমন নয়? সংস্কার তো সরকারের ওপর নির্ভর করে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “না, এটা আমাদের উপর নির্ভর করে না। এটা তাদের (জনগণের) ব্যাপার। আমরা সব সময় বলি, আমরা আপনার সঙ্গে পরামর্শ করছি। আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। আপনারা যদি বলেন- এগিয়ে যান, নির্বাচন করুন, সংস্কারের কথা ভুলে যান, আমরা নির্বাচনই করব।
“আপনি বললেন, ‘ওহ, না, এটা (সংস্কার) খুব গুরুত্বপূর্ণ; কারণ অন্য কোনো সরকার এটা (সংস্কার) করতে পারে না। পুরো ইতিহাসে আপনারাই একমাত্র ভাগ্যবান সরকার যে আপনি এই কাজটি করতে পারেন।’ সব রাজনৈতিক দল একমত হলেই হয়ে যাবে। আমরা সংস্কার করছি, তারপর নির্বাচনের আয়োজন করব।”
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের প্রশ্নে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা চিরস্থায়ী সরকার নই। উদাহরণস্বরূপ একটি নিয়মিত সরকারের মেয়াদ থাকে পাঁচ বছরের জন্য। নতুন সংবিধানে চার বছর বলা হতে পারে, সম্ভবত, কারণ মানুষ দ্রুত সময়ের মধ্যে…।
“এটি (অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ) চার বছরের নিচে হওয়া উচিত। এটা নিশ্চিত। কমও হতে পারে। জনগণ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়- সেটাই বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে- (সংস্কারের কথা) ভুলে যাও, নির্বাচন দাও, চলো (নির্বাচন) করি, আমরা করব।”
আলজাজিরা প্রশ্ন রেখেছিল, তাহলে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার চার বছর থাকছে কি না?
জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, “আমি এটা বলিনি যে আমি চার বছর থাকব। আমি বলছি যে ওইটা সর্বোচ্চ সময় হতে পারে। কিন্তু সেটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি সম্পন্ন করা।”
ইউনূসের নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগ্রহ আছে কি না, জানতে চেয়েছিল আলজাজিরা। উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “না, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি যা করছি তা উপভোগ করছি। আমার জীবন শেষ পর্যায়ে, এখন আমার (ভূমিকা) পরিবর্তন করতে চাচ্ছি না।”
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কীভাবে চলবেন বলে পরিকল্পনা করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “অতীতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি, তাই ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি যদি রিপাবলিকান পার্টির কথা বলেন, আমার বন্ধু আছে, ডেমোক্রেটিক পার্টিতে আমার বন্ধু আছে।
“হাউজই আমার জন্য কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদকের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। দুই পক্ষের শতভাগ ঐকমত্য। সেখানে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। রিপাবলিকান পার্টি বা ডেমোক্রেটিক পার্টি বা ট্রাম্পের বিষয়ে আমার কখনও কোনো সমস্যা হয়নি।”
তিনি বলেন, “ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেই হঠাৎ করে নেতিবাচক কিছু হওয়ার দেখছি না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এমন কিছু নয় যে- প্রেসিডেন্ট কে হবেন তার ওপর নির্ভর করে এদিক-ওদিক ঘুরপাক খায়। এই নীতির একটি স্থিতিশীল অংশ রয়েছে।”
শেখ হাসিনার অভিযোগ, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে, যা বাইডেন প্রশাসন অস্বীকার করেছে। এ বিষয়ে ইউনূসের ভাষ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল।
জবাবে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশে থাকেন তাহলে আপনি এই ধরনের (তত্ত্ব) জিনিসের জন্য পাগল হয়ে যাবেন। এরা হল সেই ছাত্র- যারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে, জীবন দিয়েছে এবং চারদিক থেকে উন্মত্ত জনতা যখন তাদের (গণভবন) বাড়িতে ঢুকছে, তখন লক্ষ লক্ষ জনতা তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে।
“তার পরিবার বলছিল, এবার পালানোর সময় হয়েছে, কারণ তা না হলে জনতা পুরো বাড়িটা দখল করে নেবে এবং এটা হয়ে যাবে। তাই তিনি (শেখ হাসিনা) সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান তাকে দেশের বাইরে যেতে সাহায্য করার জন্য এবং দেশত্যাগ করে তার ভারতে যেতে সহায়তা করে সেনাবাহিনী। কীভাবে (ক্ষমাতুচ্যত) হয়েছিল? এটাই হচ্ছে ঘটনা। সেনাবাহিনী বা কাউকে পাঠানোর বিষয়ে কেউ কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে – ব্যাপারটা সেরকম নয়। এটি একটি ছাত্র আন্দোলন এবং দেশের সব মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।” বিডিনিউজ২৪ডটকম
পাঠকের মতামত: