কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে জন্মহার, জনবিস্ফোরণের শঙ্কা

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে ৩৩ হাজার শিশু। যেভাবে দিন দিন রোহিঙ্গা শিশুদের এই জন্মের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে রীতিমতো জনবিস্ফোরণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে কক্সবাজার-টেকনাফ ‘রোহিঙ্গা শহরে’ পরিণত হবে মনে করছেন সচেতন মহল। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অনেকে।
কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলছে নানান চিন্তা-ভাবনা ও নানা জল্পনা কল্পনা। উখিয়া-টেকনাফ-নোয়াখালীর ভাসানচরসহ ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। তার মধ্যে দুটি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে- টেকনাফ মুচনী রেজিস্টার ক্যাম্প ও উখিয়া কুতুপালং রেজিস্টার ক্যাম্প।

৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছরে ৩৩ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে। জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে এক হাজার শিশুর মৃত্যুর হলেও প্রতি বছর ৩২ হাজার রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পে বেড়ে উঠে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু কিছু শিশু রাস্তায় ঘরবাড়িতে গড়াগড়ি করছে। আবার কিছু কিছু শিশু স্কুলে ইংরেজি, গণিত ও রোহিঙ্গা ভাষায় পাঠ নিচ্ছে। এসব শিশুদের বেড়ে উঠা নিয়ে টেকনাফের মানুষের বিরাজ করছে আতঙ্ক। যেভাবে দিন দিন রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের যদি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না হয় তাহলে কক্সবাজার-টেকনাফ রোহিঙ্গা শহরে পরিণত হবে মনে করছেন সচেতন মহল।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফ ও নোয়াখালীর ভাসানচরে ৩৪টি আশ্রয় শিবির রয়েছে। রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এরমধ্যে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

টেকনাফ শালবাগান ২৬নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্কুল শিক্ষক মো. জিয়া বলেন, এই স্কুলে আমি শিক্ষকতা করি। ছাত্রদের সাতটি বিষয়ে পড়াশোনা করায়। আমরা আগে মিয়ানমারে ছিলাম, মিয়ানমারের সরকারের নির্যাতনের কারণে আমরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। বাংলাদেশে থাকার পরও আমাদের ছেলে মেয়েদের পড়া শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো- আমাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে। একদিন না একদিন আমাদের দেশে চলে যেতে হবে। আমাদের ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে কিছু করার আশা নেই। আমাদের দেশে গিয়ে একদিন না একদিন চাকরি করব। শিক্ষিত হয়ে সকল জাতের মানুষের সাথে যেন চলাফেরা করতে পারি। আমরা শিক্ষিত জাতি হিসেবে মিয়ানমারে কাজ করব।

টেকনাফের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয়দের দাবি, ৫০ বছরে দেশে বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১৫-১৬ লাখ ছাড়িয়েছে। সঠিক সংখ্যা সরকারের কাছে না থাকার কারণে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তায় জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে।

শালবাগান ২৬নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্কুল শিক্ষক মো. নুর বলেন, আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে পড়া লেখার শিক্ষা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- শিক্ষিত হয়ে কেউ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আর যদি পড়া লেখা না করে- এইখানে ডাকাত-সন্ত্রাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা তাদেরকে শিক্ষিত জাতি হিসেবে তৈরি করতে চাই।

মিয়ানমারে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। বাংলাদেশে আমাদের ছোট ছোট শিশুদের পড়া লেখার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য আমরা অনেক খুশি। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য একটাই- আমরা দেশে ফিরে যাব। এই দেশ থেকে পড়ালেখা করে মিয়ানমারে শিক্ষিত জাতি হিসেবে বিভিন্ন কর্মস্থলে ভূমিকা রাখব। বাংলাদেশে পড়া লেখা করে কিছু করার ইচ্ছা নেই। শুধু আমাদের দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পদে পদে ভূমিকা পালন করবে রোহিঙ্গা শিশুরা।

টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক শরণার্থী। বাকিরা আশ্রিত বা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় চাপ সৃষ্টি করেছে।

সচেতন মহল মনে করেন, রোহিঙ্গাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করা জরুরি। এই ডেটাবেজ থাকলে রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া, ভোটার হওয়া, বাংলাদেশের নাগরিক সনদ নেওয়া, পালিয়ে বিদেশ যাওয়া এগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তারা মনে করেন, ২০১৭ সালের আগস্টে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছিল। সেখানে অনেক কিশোর-কিশোরী ছিল। তারা এরই মধ্যে বিয়ে-শাদি করেছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পারভেজ চৌধুরি বলেন, দেশে যেভাবে রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে তা অতুলনীয়। দ্রুত তাদের দেশে ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে দিন দিন এ সমস্যা সৃষ্টি হবে। নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা তরুণরা।

পাঠকের মতামত: