কক্সবাজার, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ভুয়া এনজিওর খপ্পরে লাখো মানুষ

ষাটোর্ধ্ব হেনা বেগম। এই পৃথিবীতে আপন বলতে তার কেউ নেই। প্রায় এক দশক ধরে অন্যের বাড়িতে কাজ ও ভিক্ষা করে জমিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। গত আগস্টে তার জমানো সব টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে কনফিডেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামের একটি ভুয়া এনজিও।

শুধু হেনা বেগম নয়, দিনমজুর হারুন আলীর জমানো ৪০ হাজার টাকা, রাণি বেগমের জমি বিক্রি করা ৪ লাখ টাকাও গেছে ওই এনজিওর পেটে। ভালো মুনাফার আশা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটের কয়েক শ গ্রাহক থেকে কোটি টাকা তুলে গত আগস্টে উধাও হয়ে গেছে নামসর্বস্ব এনজিওটি।শুধু কানসাট নয়, চলতি বছরেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত দুই ডজন এনজিওর বিরুদ্ধে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিনমজুর, ভিক্ষুক, কৃষক, ভ্যানচালক, বিধবা- কেউই রেহাই পায়নি এসব প্রতারকের খপ্পর থেকে।

এ নিয়ে থানায় অভিযোগ, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন- সবকিছুই করেছেন ভুক্তভোগীরা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলেনি হারিয়ে যাওয়া অর্থ। ছোটখাটো অনেক অভিযোগ আলোচনায়ই আসেনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে শতাধিক ভুয়া এনজিও।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মূলত গ্রামের দরিদ্র, কম শিক্ষিত মানুষদের টার্গেট করেই গজিয়ে উঠছে এসব এনজিও। চাকরি, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কাজের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, অল্প সুদে বড় অঙ্কের ঋণ, টাকা জমা রাখলে ব্যাংকের চেয়ে দুই-তিন গুণ মুনাফা দেওয়া ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েই লাপাত্তা হচ্ছে এসব এনজিও। যেখানে দারিদ্র্য বেশি, শিক্ষার হার কম, সেখানেই ভুয়া এনজিওর ছড়াছড়ি। ধরা পড়ার আশঙ্কায় কিছু প্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহের মধ্যেই অফিস গুটিয়ে গা ঢাকা দিচ্ছে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (নিবন্ধন ও নিরীক্ষা) মো. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু বিদেশি দান নির্ভর এনজিওগুলোই এখানে নিবন্ধিত।

আমাদের আগে সমাজসেবা অধিদফতর, জয়েন্টস্টক, মহিলা বিষয়ক অধিদফতর এনজিও নিবন্ধন দেয়। যারা নিবন্ধন দেবে, তারাই এই প্রতারণার বিষয় দেখবে। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নিবন্ধিত এনজিওর তালিকা থাকে। তারা দেখবে। যারা এনজিওতে বিনিয়োগ করবে, তাদেরও সচেতন হতে হবে। তারা ডিসি অফিস বা ইউএনও অফিসে খোঁজ নিতে পারে। ভুয়া হলে অভিযোগ দিতে পারে।প্রতারিত গ্রাহকরা বলছেন, ভুয়া এনজিওগুলো নকল কাগজপত্র দেখাচ্ছে, যা যাচাই করা গ্রামের কম শিক্ষিত দরিদ্র মানুষগুলোর পক্ষে সম্ভব না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস গড়ে ওঠায় সেগুলো বৈধ বলেই মনে করছেন গ্রাহকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাসেই ফরিদপুরের নগরকান্দায় গ্রাহকের প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে ফেমাস বাংলা ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও। মেহেরপুরে গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে সোনালী ফাউন্ডেশন (মেহেরপুর ব্রাঞ্চ) নামের একটি এনজিও। ১ লাখ টাকা জমা দিলে তিন দিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা ঋণের লোভ দেখিয়েছিল সংস্থাটি। গত সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রূপালী ফাউন্ডেশন নামের একটি ভুয়া এনজিও প্রায় তিন শতাধিক গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। টাঙ্গাইল শহরের ময়মনসিংহ রোডে অবস্থিত সাবালিয়ায় গ্রিণ বাংলা ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি এনজিও টাঙ্গাইল পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে প্রশিক্ষণের নামে স্থানীয় নারীদের প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। মেহেরপুরের গাংনীতে ঋণ দেওয়ার কথা বলে দুই শতাধিক নারী-পুরুষের কাছ থেকে জামানতের ১৫ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে পল্লী উন্নয়ন সমিতি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গত দুই বছরে চার-পাঁচটি এনজিওর বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালানোর খবর পাওয়া গেছে। ঝালকাঠির নলছিটিতে গত আগস্টে গ্রাহকের প্রায় ২০ লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে সোনার বাংলা নামের এনজিও। ভোলার তজুমদ্দিনে ঋণ দেওয়ার কথা বলে ২৫টি এলাকায় সমিতি গড়ে গ্রামের মানুষের প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে উধাও হয়েছে নবলোক নামের এনজিও। পুরাতন পঞ্চগড়ের ধাক্কামাড়া এলাকায় আর্স বাংলাদেশ নামের এনজিওর শাখা অফিস পরিচয় দিয়ে গত মে মাসে কার্যক্রম শুরু করে জুনেই কয়েকটি গ্রামের দরিদ্র নারীদের লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে প্রতারকচক্র।

গত মার্চে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে আত্মসেবা ফাউন্ডেশন নামের একটি ভুয়া এনজিও গ্রাহকের প্রায় ২০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। জানুয়ারিতে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলায় ঋণ দেওয়ার নামে ৫০০ গ্রাহকের ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে উধাও হয় সহায়ক সংঘ ঝিনাইগাতী নামের এনজিও। এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতেই নরসিংদী সদরের ঘোড়াদিয়া এলাকায় গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে উধাও হয়েছে শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। নিজেদের সরকার অনুমোদিত দাবি করে ভালো মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে বগুড়ার ধুনটে রুদ্র ফাউন্ডেশন, গাইবান্ধায় বাদিয়াখালী দুস্থ মাতা মহিলা উন্নয়ন সমিতি ও সরণা বাংলাদেশ, ভোলায় সকস বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দিগন্ত কুসুমকলি ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, রাজশাহীর পুঠিয়ায় বর্ষা মাঝদিঘা ক্ষুদ্র সমবায় সমিতি লিমিটেড, বগুড়ার ধুনটে আদ-দ্বীন ওয়েলফেয়ার, রংপুরে জাগরণী সংস্থা, শরীয়তপুরে ডামুড্যা মহিলা উন্নয়ন সোসাইটি, মাদারীপুরে পল্লী প্রগতি ফাউন্ডেশন, কিশোরগঞ্জে গ্রাম উন্নয়ন সংস্থাসহ অসংখ্য ভুয়া এনজিওর বিরুদ্ধে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পাঠকের মতামত: