কক্সবাজার, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর আস্থা-বিশ্বাসের কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম

তোরা দেখিস, যেদিন আমার চট্টগ্রাম জাগবে সেদিনই আমার বাঙালি জাগবে, আমার স্বাধীনতা আসবে, আমার বিজয় আসবে।’ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক নুরুল ইসলাম তার এক লেখায় চট্টগ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আস্থার বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামকে কতটা ভালোবাসতেন, কতটা বিশ্বাস রাখতেন চট্টগ্রামের মানুষের ওপর, তা বুঝতে চোখ রাখতে হবে ১৯৬৬ থেকে ’৭৫ এর কালরাতের আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তার শাহাদাতের ৪৫ বছর পর সেই ইতিহাসে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ‘আস্থার’ কেন্দ্রে থাকা এ চট্টগ্রামে তিনি ছুটে এসেছেন বারবার। তাই তো ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ কিংবা ‘৬ দফার ঘোষণা’ সবই এসেছে চট্টগ্রামের মাটি থেকেই।

১৯৪৩ সাল থেকে যে সম্পর্কের শুরু

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের কিছু তরুণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পেছনে চট্টগ্রামের রাজনীতির কিংবদন্তি মরহুম এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর অবদান পাহাড়সম। বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থা ছিল এ দুই মহারথীর ওপর।

চট্টগ্রামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের সূচনা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর মাধ্যমে বলে মনে করা হয়। এর প্রামাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘শহীদ (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের বাড়িতে দুই দল (অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ) বসেও যখন আপস হলো না, তখন ইলেকশনে লড়তে হবে। ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগকর্মীদের সাহায্য নিয়ে দখল করতে সক্ষম হলেন। খান বাহাদুররা জেলা লীগ কনফারেন্সে পরাজিত হলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে চট্টগ্রামের এ কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আজ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অটুট আছে।

১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের রাজনীতিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও দ্রুতই তা পোক্ত হয়ে ওঠে। মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৪৫ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজদের নিয়ে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন বঙ্গবন্ধু।

জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে (১ জুলাই ১৯৭৪, অপরাহ্ন ৩টা ৩০ মিনিট) উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের ওপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে এ ঘটনার বিষয়ে জানা যায়।

সেদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘১৯৪৩ সালে তার (জহুর আহমদ চৌধুরী) সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি, তখন জহুর আহমদ চৌধুরীর মতো এম এ আজিজও আমার সাথে ছিলেন।একদিনের জন্যও তিনি এ দেশের জনসাধারণ এবং তাদের ন্যায্য দাবির সংগ্রাম থেকে দূরে সরে দাঁড়ান নাই।

সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পরের বছর আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামনের সারিতে ছিলেন চট্টগ্রামের নেতারা। সংগঠন গঠনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের শুরুতেই ঢাকার বাইরে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর প্রথম যে দু-একটি জেলায় কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে চট্টগ্রাম ছিল অন্যতম।

সেই ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘…আমরা এখনও জেলা কমিটিগুলো গঠন করতে পারিনি। তবে দু-একটি জেলায় কমিটি হয়েছিল। চট্টগ্রামে এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং যশোরে খড়কির পীর সাহেব ও হাবিবুর রহমান অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বে।’

পরে আরও স্পষ্ট করে লিখেছেন, ‘…নোয়াখালীতে আবদুল জব্বার খদ্দর সাহেব জেলা কমিটি গঠন করেছেন। চট্টগ্রামের আবদুল আজিজ, মোজাফফর (সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ-লেখক), জহুর আহমদ চৌধুরী ও কুমিল্লায় আবদুর রহমান খান, লাল মিঞা ও মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন।’

লালদীঘিতে কানপাতলেই যেন শোনা যাবে সেই তেজোদীপ্ত ভাষণ

স্বাধীনতার পথপরিক্রমায় জনমত গঠনে বারবার চট্টগ্রামে ছুটে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান, জেএম সেন হলের মাঠ, পলোগ্রাউন্ড ময়দান কিংবা এম এ আজিজ (সাবেক নিয়াজ স্টেডিয়াম) স্টেডিয়ামে আজও কানপাতলে যেন শোনা যাবে জাতির পিতার তেজোদীপ্ত সেই ভাষণ।

mujib

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ছিলেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে প্রথমবারের মতো বক্তব্য দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে পাঁচ হাজার মানুষের সমাবেশ হয়।

সেদিন মাওলানা ভাসানীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কারণে, দেশটি ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। সরকার ভুলভাবে মওলানা ভাসানীকে অতীতের কাজের জন্য আটক করেছে (অনুবাদ)।

পরে ১৯৫৪ সালে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেই নির্বাচনী প্রচারণায় আবারও লালদাীঘিতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্তকর্মী নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রথম দেখেন ১৯৫৪ সালে। তখন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে নির্বাচনী প্রচারণায় চট্টগ্রাম আসেন শেখ মুজিব। লালদীঘি ময়দানের বিশাল জনসভায় বক্তব্য দেন তারা। সেখানে শেখ মুজিবের ভাষণ শুনে ভক্ত হয়ে যান মুসলিম হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নূর মোহাম্মদ।

বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন শাহ বদিউল বলেন, “১৯৫৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় খেলতে গিয়ে লালদীঘি মাঠে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখি। সেই থেকে গোফওয়ালা তরুণ বয়সী একজন বক্তব্য দিতে ওঠেন। মাইকের ঘোষণায় জানতে পারি তার নাম শেখ মুজিব। তার বক্তব্যের স্টাইল আর ব্যক্তিত্ব আমাকে মোহিত করে। এমন বক্তব্য অতীতে শুনিনি। তারপর থেকে শেখ মুজিব আসার খবর পেলে তার বক্তব্য শোনার জন্য প্রতিটি মিটিংয়ে ছুটে যেতাম।

১৯৫৬ সালে নেতাদের বিশাল বহর নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সেবারও সাথে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশে নেতাদের বহরে ছিলেন মানকি শরীফের পীর, জাকারিয়া শরীফের পীর, অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি গোলাম মো. খান লুন্ধখোর, সিন্ধুর জিএম সাইয়েদ (সিন্ধুর গান্ধী হিসেবে পরিচিত) প্রমুখ।

একই বছর সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে আবার লালদীঘি ময়দানে আসেন শেখ মুজিব। শাহ বদিউল বলেন, “ওই সময়ের বক্তব্য এখনও কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন- কে, কোথায়, কীভাবে দুর্নীতি করে তা তিন পয়সা খরচ করে পোস্ট কার্ডে লিখে আমাকে জানালে আমি দুর্নীতিবাজকে বের করে আনব।”

mojib

>> বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন নূর মোহাম্মদ চৌধুরীকে জেল থেকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি

ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা ও লালদীঘি

বঙ্গবন্ধু ও চট্টগ্রামে তার সঙ্গীদের মধ্যে কত গভীর আস্থার সম্পর্ক ছিল তার প্রমাণ ছয় দফা ঘোষণার জন্য চট্টগ্রাম-কে বেছে নেয়া। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের প্রতি অবিচল আস্থা থেকে ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা। চট্টগ্রাম ঢুকে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে। চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে মুক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, আন্দোলন সংগ্রামের পাদপীঠ।

৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে ছয় দফার বিষয়ে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সরকার তো বটেই আওয়ামী লীগের অনেকেই ছয় দফার বিরোধিতা করেছিল। এ অবস্থায় ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায়ও ছয় দফার বিরোধিতার মুখে বঙ্গবন্ধুর পাশে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছয় দফার পক্ষে প্রথম বিবৃতি দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাশেম (সাব-জজ) প্রমুখ।

এ ঘটনার কয়েকদিন পরেই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রামের জনসভায় ছয় দফা ঘোষণার। সে সময়ের কথা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, “টেলিফোনে শেখ সাহেব বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ২৫ তারিখ লালদীঘির ময়দানে ছয় দফা ঘোষণা করব’।

“আমি বললাম, ঢাকা থেকে করলে ভালো হয় না? শেখ সাহেব বলেন, ‘দেখ, ঢাকাইয়ারা তোদের মতো অর্গানাইজ করতে পারবে না। তা ছাড়া সারাদেশে চট্টগ্রামের একটি নাম আছে, চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ, ওইখান থেকে আমি শুরু করতে চাই’।

mojib

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নগর আওয়ামী লীগ নেতারা

বঙ্গবন্ধুর এ আস্থায় সাড়া দিয়ে জনসভা আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয় চট্টগ্রাম থেকে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ইতিহাস সৃষ্টির দিনেও তিনি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিলেন চট্টগ্রামের ওপর এবং তার বিশ্বস্ত জহুর আহমদ চৌধুরীর ওপর।

২৬ মার্চ ১৯৭১, ইতোমধ্যে রাজধানীতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্তানি হানাদারেরা। গ্রেফতার হবেন বা কিছু একটা ঘটবে, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু সেটা দেশবাসীকে জানানোর কোনো মাধ্যম ছিল না। একে একে সব সহকর্মীকে বিদায় দিয়েছেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে তিনি একা। টেলিফোনে কাউকে জানাবেন, সে পথও বন্ধ। কারণ তার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। সেই সংকটময় মুহূর্তে তার মনে পড়েছিল দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর কথা। চট্টগ্রাম তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোনোভাবে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারলে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করবেন।

যেমনটি ভাবা, সেভাবেই কাজ করলেন… পরেরটা ইতিহাস। পাশের এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠালেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। ওয়্যারলেসেও পাঠালেন। রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ঢাকার পিলখানা থেকে ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা পান চট্টগ্রামের হালিশহরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) ৫ নম্বর সেক্টর সদর দফতরের সিগন্যালম্যান হিসেবে কর্মরত আবুল খায়ের।

mojib

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে তার আস্থাভাজন নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদি

ওই বার্তাতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। ওপরে লেখা ছিল- ‘মেসেজ ফ্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। নিচে লেখা- ‘দিস মেসেজ পাস টু বেঙ্গলি অফিসার’। বার্তাটি তিনি চট্টগ্রাম ইপিআরে দায়িত্বরত বাঙালি অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন) কাছে হস্তান্তর করেন। রফিকুল ইসলাম সেই রাতে সেক্টর সদর দফতরে ডিউটিতে ছিলেন। এই মেসেজের আলোকেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়।

এদিকে লোকমারফত পাওয়া বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি প্রচারের গুরুদায়িত্ব নেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নেতার দেয়া দায়িত্ব সেদিন তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণার অজস্র কপি সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে জনসাধারণের মাঝে বিলির ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রামের মানুষ মুহূর্তের মধ্যে জেনে যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

বঙ্গবন্ধু তার নির্দেশবার্তায় বলেন, “পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে। নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। বিশ্ববাসীর কাছে আমার আকুল আহ্বান, আমাদের সাহায্য করুন। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে লড়াই করছে। আমি আপনাকে আহ্বান করছি, আদেশ দিচ্ছি, আল্লাহর নামে যুদ্ধ করুন, শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও দেশকে মুক্ত করুন। পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসার বাহিনীকে হাতিয়ার তুলে নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলুন। কোনো আপস নয়। জয় আমাদের হবেই। মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে শেষ শত্রুটিকে তাড়িয়ে দিন। সমস্ত আওয়ামী লীগার, কর্মী এবং সকল দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের ঘরে ঘরে আমার এ নির্দেশ পৌঁছিয়ে দিন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন।

সেদিনের কথা স্মরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান প্রথমবার এবং সন্ধ্যায় আবুল কাশেম সন্দ্বীপে দু-দুবার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। পরে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। এছাড়া জহুর আহমদ চৌধুরী কাছে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি সাইক্লোস্টাইল কপি সারা শহরে আমরা বিলি করেছিলাম।

চট্টগ্রাম থেকেই স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রনীতি, রণনীতি ও অর্থনীতির ঘোষণা

mojib

বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম বন্ধু চট্টগ্রামের এম এ আজিজ

স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে সে সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শহরের স্থানীয় এক হোটেলে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই দেশের মধ্যে এবং সমগ্র বিশ্বের জন্যই আমরা শান্তি কামনা করি।

জনগণের ওপর তার অগাধ আস্থার পরিচয় দিয়ে সেদিন তিনি বলেন, ‘একমাত্র গণতন্ত্রই সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম সফর করেন। চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ওই বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ হবে কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের দেশ। ধনীদের এখানে আরও ধনী হতে দেয়া হবে না। ব্যাংক, বীমা, পাটকল, চিনিকল ও বস্ত্রমিল জাতীয়করণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি জানি শিল্পপতিরা এতে খুশি নন। কিন্তু এখন থেকেই শিল্পপতিদের জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। সব প্রতিষ্ঠান আমি আমার নিজের জন্য জাতীয়করণ করিনি, জনগণের জন্যই করেছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এখন এসব সম্পত্তির মালিক। মূলত এ থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ অর্থনীতির রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের নৌ-ঘাঁটিতে বাহিনীকে নিশান প্রদান করতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি চট্টগ্রাম নৌ-ঘাঁটির নামকরণ করেন বিএনএস ঈসা খান এবং মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদদের স্মরণে প্রথম প্রশিক্ষণ জাহাজটির নামকরণ করেন বিএনএস শহীদ রুহুল আমিন।

সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি কারও ওপর হামলার জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্যই। আমরা অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক নই। অনুরূপভাবে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপর কারও হস্তক্ষেপ বরদাশত করব না।

mujib

১৯৭০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন

বঙ্গবন্ধুর শেষ আসা, আজও স্মৃতিতে অমলিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে রাঙ্গামাটি সফরকালে সর্বশেষ চট্টগ্রামে আসেন।

বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে যৌবনের শুরুতেই চাকরি নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ছেলে মো. আবদুল মান্নান। বর্তমানে অবসরে যাওয়া আবদুল মান্নান রাঙ্গামাটির কাউখালি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে জানান, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির সেই দিনটি এখনও যেন চোখের সামনে ভাসছে তার।

mojib

চট্টগ্রামের রাউজানে এক পারিবারিক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু

আবদুল মান্নানের কাছে বেতবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধনের দিনটি এখনও ‘সেরা’। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়। ওইদিন জনমানবহীন পাহাড়ও লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বাগানে বসেই বঙ্গবন্ধু চা-পান করলেন। অদূরে শুয়ে থাকা একটি কুকুরকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুইও আমার মতো ভুখা? হাতের বিস্কুট ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘নে খা’।

মান্নান বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৪ জুন। ওইদিন সকাল ১১টায় বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের প্রথম গেটে একটি হাতি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। বেজায় খুশি হলেন তিনি। বহর নিয়েই এলেন উদ্বোধনস্থলে। প্রচুর সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি উদ্বোধনী মঞ্চ ঘিরে। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে উদ্বোধন করে মোনাজাত করলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর অফিসের ভেতরে সবটুকু ঘুরে দেখলেন। সবশেষে ফিরে গেলেন। কিন্তু সেই যাত্রাই যে শেষ যাত্রা, কে জানতো?

পাঠকের মতামত: