মিয়ানমারের মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এতে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। গত মঙ্গলবার মংডু দখলের ফলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং আগে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিষয়েও বাংলাদেশের নতুন ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এ অবস্থায় অপর প্রতিবেশী মিয়ানমার সীমান্তেও যে অস্থিরতা, তাতে নতুন সংকট তৈরি হলো। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পর্যায়ে নিজেদের পক্ষ থেকেই নিরাপত্তা সতর্কতা জোরদার করা উচিত। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাড়াতে হবে কূটনৈতিক তৎপরতা।
মিয়ানমার পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পর্যবেক্ষণ করছে। রোহিঙ্গা সংকট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে এ নিয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে।
মূলত মিয়ানমারে চলমান এ যুদ্ধে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সহযোগী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি-এআরএ ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাসহ কয়েকটি সংগঠনের অবস্থান ছিল জান্তা বাহিনীর পক্ষে। যে কারণে সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হলো।
এদিকে পশ্চিম অঞ্চলের জান্তা বাহিনীর কমান্ড হেডকোয়ার্টার দখলসহ রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। মূলত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিদ্রোহী গোষ্ঠী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য আরাকান আর্মি। এ গোষ্ঠী গত বছর অক্টোবর থেকে হামলা চালিয়ে উত্তরের শান রাজ্যের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আরাকান আর্মি গত বছর নভেম্বর মাস থেকে হামলা চালিয়ে রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৩টির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের গাওয়া, তাউনগুপ ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে। ইতিমধ্যে আন শহরে ৩০টি জান্তা ঘাঁটি দখল করেছে আরাকান আর্মি। অন্য শহর অভিমুখেও এগিয়েছে বিদ্রোহী এ গোষ্ঠী। গত মঙ্গলবার মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করে আরাকান আর্মির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তুমুল লড়াইয়ের মুখে জান্তা বাহিনীর মিত্র হিসেবে পরিচিত আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির রোহিঙ্গা মিলিশিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) বিরুদ্ধেও তারা হামলা চালিয়েছে। অব্যাহত হামলার মুখে তারাও ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েছে।
গত বুধবার মিয়ানমারের গণমাধ্যম ইরাবতীর এক খবরে দাবি করা হয়, মংডুর দখল করা সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে কুখ্যাত সেনা কর্মকর্তা ব্রিডেগিয়ার জেনারেল থুরিন তুনসহ জান্তা বাহিনীর কয়েকশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আরাকান আর্মি।
নাফ নদে নিরাপত্তা জোরদার : মংডু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদের মিয়ানমারের অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরাকান আর্মি। ওই ঘোষণার পর নাফ নদে নৌ চলাচলে সতর্কতা জারি করে বাংলাদেশও। বাড়ানো হয়েছে বিজিবির টহল। সীমান্তে অযাচিত যাতায়াত বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জনসাধারণকে সতর্ক করে মাইকিং করা হচ্ছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। যদিও এরপর থেকে টেকনাফ সীমান্তে সে দেশে থেকে কোনো ধরনের গোলার বিকট শব্দ ভেসে আসেনি।
এ ছাড়া নাফ নদে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যেন কোনোক্রমেই কোনো নৌকা না যায়, সেজন্যও সতর্কতা জারি রেখেছে প্রশাসন। কেউ যেন সীমানা ক্রস করে এদিকে না আসে সেদিকে নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট নৌকাগুলোকে নাফ নদে বাংলাদেশ অংশে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলেও বড় ট্রলার, বড় জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তের নাফ নদে টহল তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে এবং বাংলাদেশের জলসীমায় বিদ্যমান দ্বীপের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৌ টহলও জোরদার করা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে নতুন সংকটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত আশঙ্কা হলো সীমান্ত দিয়ে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। আবার বাংলাদেশে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন। আরও একটি বিষয় যুক্ত হচ্ছে, সেটা হলো মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য ইস্যু।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গারা এখন আবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে। সরকারকে সেটা প্রতিরোধে উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে।
মিয়ানমারের গণমাধ্যম ইরাবতী এক প্রতিবেদনে রাখাইনে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী একজন সামরিক বিশ্লেষকের উদ্ধৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য পুনঃস্থাপন করলে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের দুর্দশা কমবে। সামরিক ওই বিশ্লেষক বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে হবে।
গত মাসে জাতিসংঘ জানায়, রাখাইনে ২০ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। জান্তার পক্ষ থেকে এসব রাজ্যে যাওয়ার জন্য সড়ক ও নৌপথ অবরোধ করে রাখা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাসহ খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সেখানে যেতে পারছে না।
রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কক্সবাজারে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে সরকারের কাগজ-কলমেই। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে আর রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ২৭০ কিলোমিটার দখলে নিয়েছে। তাদের দখলে নেওয়া এলাকাগুলোতেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করে। আবার আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করেছে এমন উগ্রবাহিনী রয়েছে। তারাও অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে। ফলে আমাদের এখন খুব বুঝেশুনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ দেশ রূপান্তর
পাঠকের মতামত: