কক্সবাজার, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

টেকনাফ উপকূল সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে ঝাউবন উজাড়

আব্দুর রহমান, টেকনাফ::

কক্সবাজারের টেকনাফে উপকূলের রক্ষক হিসেবে পরিচিত ঝাউবন উজাড় হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জোগসাজশে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীরা ঝাউগাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক সপ্তাহে এখান থেকে অন্তত এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে।

টেকনাফে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রায় ১ হাজার ১০০ একরে গড়ে তুলেছে সাবরাং পর্যটন পার্ক। এই পার্কের ভেতর সমুদ্রসৈকত ধরে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত রয়েছে সাড়ে চার কিলোমিটার ইটের সড়ক। এখানে দৃষ্টিনন্দন ঝাউবনের পাঁচ থেকে ছয়টি স্থান থেকে অবাধে গাছ কাটা হচ্ছে। বন উজাড় হওয়ায় সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে দ্রুত ভাঙছে রাস্তা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সৈকতের অনেক জায়গা থেকে ঝাউগাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। এ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হতে পারে। সাবরাং পর্যটন পার্কের অসাধু কর্মকর্তাসহ বন বিভাগের সহায়তায় স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী চক্র এসব গাছ কাটছে।

সরেজমিন টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কে দেখা যায়, জিরো পয়েন্ট, কাটা বনিয়া, কচুবনিয়াসহ চার-পাঁচটি স্থানে হাজারের বেশি গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারিবদ্ধ গাছের মাঝে মাঝে ফাঁকা। পড়ে রয়েছে কাটা গাছের অসংখ্য গোড়া। কিছু কিছু গোড়া বালু দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। অনেক গাছে রয়েছে করাত ও দা দিয়ে কাটার চিহ্ন। সাবরাংয়ের আছরবনিয়ায় মেসার্স মোস্তাক স-মিল অ্যান্ড স্টিল-১, সাবরাং বাজারের পশ্চিম পাশের মামুন স-মিল, সাবরাং রাস্তার মাথার মেসার্স এসএন টিম্বার অ্যান্ড স-মিলসহ একাধিক কাঠ কাটার মিলে ঝাউগাছের স্তূপ দেখা গেছে। অনেকের বাড়িতেও কাটা গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

এর মধ্যে মামুন স-মিলে রাখা ঝাউগাছ নিয়ে সাবরাংয়ের কাঠ ব্যবসায়ী সাকের আহমেদ বলেন, আমি বৈধভাবে বেজার দায়িত্বরত কর্মকর্তা শাহীন সরওয়ারের কাছ থেকে গাছ কিনেছি। এর পর সেই গাছ কেটে নিয়ে এসেছি। আমি ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাওয়ায় গাছগুলো কেটে বিক্রি করি।

তিনি জানান, প্রতিটি গাছ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দামে কিনেছেন। কিছু টাকা পরিশোধও করেছেন। গাছ কেনার প্রমাণ হিসেবে তিনি বেজার লোগো ও কর্মকর্তার সইযুক্ত রশিদ দেখান। বেজা কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডও রয়েছে তাঁর কাছে।

তবে সাবরাং পার্কের দায়িত্বে থাকা বেজার সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর শাহীন সরওয়ার সোহাগ দাবি করেন, সাগরের ঢেউয়ে পড়ে যাওয়া ঝাউ গাছ বিক্রির বিষয়ে স্থানীয় ওই কাঠ ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। তবে গাছগুলো বিক্রি করা হয়নি। বেজার লোগো ও সই সংবলিত রসিদ ভুয়া। ওই ব্যবসায়ী নকল করে এটি তৈরি করেছেন।

সাবরাং পার্কের (বেজার) সহকারী পরিচালক তন্ময় হাসান বলেন, বেজার লোগোযুক্ত রসিদে যে সই রয়েছে, সেটি আমার নয়। লোগোযুক্ত কাগজটি বেজার হলেও সই ঠিক নেই। ইতোমধ্যে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। যদি ঝাউবন বিক্রিতে আমাদের কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপকূল বন বিভাগ জানায়, উপকূল রক্ষায় টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ঝাউগাছ লাগায় বন বিভাগ।

উপকূল বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জের বশির আহমেদ বলেন, এই ঝাউ বাগান ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করে আসছিল। এসব গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। ২০১৫-১৬ সালে বন বিভাগের ৮৮৪ একর জমি বেজাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য ঝাউগাছগুলোও পড়ে। তখন থেকে ওই ঝাউবন রক্ষার দায়িত্ব বেজার। তবে নিয়ম হচ্ছে, গাছ কাটার আগে আমাদের জানাতে হবে।

স্থানীয় মোহাম্মদ শাহীন বলেন, বেজার অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ঝাউবনের গাছ নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। ভোরে ও সন্ধ্যায় এখানে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মূলত ঝাউবন কাটায় সড়কটি দ্রুত ভাঙছে। আমাদের এলাকা প্রবল ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। প্রতি বছরই বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। উপকূল রক্ষার দেয়াল ঝাউবন উজাড় হলে সবাই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ব।

উপকূল বন বিভাগের পাহারাদার নুরুল ইসলাম বলেন, বেজার অধীনে হওয়া ঝাউবন আমরা পাহারা দিই না। উপকূলের বাকি ঝাউবন রক্ষায় রাত-দিন পাহারা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা ঝাউগাছ কাটছে বলে তথ্য পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, ঝাউবন আমাদের উপকূল রক্ষা করে। যদি অবৈধভাবে কোনো কর্মকর্তা ঝাউবনের গাছ বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকেন, বেজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: