বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের ওপারেই মিয়ানমার। কয়েকটি ছোট পাহাড় বেয়ে সহজে হেঁটে যাওয়া যায়। এই পথকে বার্মিজ গরু পাচারের ‘নতুন রুট’ হিসেবে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। গত তিন মাস ধরে প্রতি রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের নতুন এই রুটে গরু পাচার হয়ে আসছে। পাচারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত বলে জানিয়েছেন ওসব এলাকার বাসিন্দারা।
সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি সকালে বান্দরবানে ৮০টি বার্মিজ গরু আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির আলীকদম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আটক ৮০টি গরুর আনুমানিক বাজার দর এক কোটি টাকা।’
স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমারে গরুর দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। বেশি দাম পাওয়ার আশায় বাংলাদেশে গরু পাচার করা হয়। আগে আলীকদম ও লামা সীমান্ত দিয়ে বার্মিজ গরু পাচার হলেও বর্তমানে নতুন পথ বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গরু পাচার করে আসছে পাচারকারীরা। অনেকে গরু পাচারের পাশাপাশি ইয়াবাসহ নানা মাদকদ্রব্য পাচার করছে। মাঝেমধ্যে উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাচার হওয়া গরু আটক করলেও পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। প্রতি রাতেই বার্মিজ গরু পাচার হয়। পাচারকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, বিএনপি ও স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী একজোট হয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। পাচারকারীদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকায় স্থানীয়রা প্রতিবাদের সাহস পান না। স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালালেও পাচার বন্ধ হয় না।
স্থানীয় দুজন জনপ্রতিনিধি জানান, গত তিন মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী সদর ইউনিয়নের কম্বোনিয়া, জারুলিয়াছড়ি, ফুলতলী, আশারতলী, জামছড়ি, চেরারকুল, চাকঢালা, নিকুছড়ি ও বাইশারীর ঈদগড়, আলীক্ষ্যং, কাগজীখোলাসহ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে বার্মিজ গরু পাচার হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, কুতুব মেম্বার, জিয়াবুল, গিয়াসউদ্দিন, আতাউল্লাহ, জহির উদ্দিন, আলী হোসেন, নুরুল ইসলাম, আবদুল গফুর, নুরুল আবছার সোহেল, জাকের আহমদ, ফকির আলম, আবু নোমান, নজরুল ইসলাম, কচ্ছপিয়ার জসিম উদ্দিন, জহির উদ্দিন, আবুল কালাম, এম সেলিম, সোহেল সিকদার, আবদুর রহিম ও বাইশারীর মো. আলম গরু পাচারে জড়িত। এদের মধ্যে কেউ গরু বেচাকেনা করেন, কেউ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পাচারে সহযোগিতা করেন আবার কেউ ইয়াবা পাচার করেন।
এছাড়া কুতুব মেম্বার, রামুর কচ্ছপিয়ার জহির উদ্দিন ও জিয়াবুলসহ কয়েকজন খামার দিয়ে দেশি গরুর পাশাপশি বার্মিজ গরু পালন করেন। পরে সুযোগ বুঝে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করেন। প্রতিদিন তাদের খামার থেকে গরু পাচার হয়। আবার মিয়ানমার থেকে তাদের খামারে গরু নিয়ে আসেন। পাচারের সময় মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে কিছু গরু ধরা পড়লে পরে নিলামে সেসব গরু কিনে বিক্রি করে তারা। তবে গরু ধরা পড়লেও পাচারকারীরা ধরা পড়ে না।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘সদর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন বলেন, ‘গত মাস তিন-চার মাস ধরে সদর ও বাইশারী ইউনিয়ন দিয়ে গরু পাচার হচ্ছে। বিজিবি, পুলিশ ও প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করেও পাচার বন্ধ করতে পারছি না। কারা পাচার করছে তা জানি না।’
গরু পাচারে আপনার সম্পৃক্ততা আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা, এ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার নাম বলেছেন, শত্রুতা করেও কেউ কেউ হয়তো বলেছেন। তবে ব্যাংক লেনদেন যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সহজেই গরু পাচারকারীদের ধরা সম্ভব। এছাড়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা গরু বিক্রির নিলামে অংশ নেন তাদের ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করলে পাচারে জড়িতদের ধরা সম্ভব।’
‘তবে এটি সত্য গরু পাচারের আড়ালে অনেকে ইয়াবাসহ নানা মাদকদ্রব্য পাচার করছে। তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই’ যোগ করেন চেয়ারম্যান নুরুল আবছার।
‘তবে এটি সত্য গরু পাচারের আড়ালে অনেকে ইয়াবাসহ নানা মাদকদ্রব্য পাচার করছে। তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই’ যোগ করেন চেয়ারম্যান নুরুল আবছার।
তবে গরু পাচারে স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও সহযোগিতা করছেন দাবি করে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান মো. কুতুব উদ্দিন ওরফে কুতুব মেম্বার বলেন, ‘গরু পাচারের সঙ্গে এখানের বেশিরভাগ চেয়ারম্যান-মেম্বার জড়িত। আপনারা খবর নিলে জানতে পারবেন। শুধু আমাকে একা জড়ালে তো হবে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে সবার নাম বেরিয়ে আসবে। এর সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন জড়িত।’
বাইশারী থেকে সাত-আট কিমি দূরের সীমানা দিয়ে গরুগুলো লামার ফাঁসিয়াখালী হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাইশারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আলম। তিনি বলেন, ‘পাচারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে তুলেছি। পুলিশের অভিযানে কয়েকদিন আগে ১৯টি গরু জব্দ করা হয়। দুর্গম এলাকা হওয়ায় আমরা ওখানে যেতে পারি না। আমি গরু পাচারে জড়িত থাকলে কখনও অভিযানে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতাম না।’
গরু পাচার বন্ধে পুলিশের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি টান্টু সাহা বলেন, ‘বার্মিজ গরু পাচার বন্ধে আমরা তৎপর রয়েছি। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। সম্প্রতি অভিযানের সময় পাচারকারীদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের আপস নেই। আমরা অভিযানের সময় যাকে পাবো, তাকেই ধরবো।’
গরু পাচারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত আছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘পাচারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত বলে অনেকে আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন। তবে এখনও প্রমাণ পাইনি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’
নতুন রুটে বার্মিজ গরু পাচার হচ্ছে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা। তিনি বলেন, ‘পাচারে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। কিন্তু এখনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হাতে পাইনি। পুলিশ, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অভিযানে গিয়েও জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি। আবার তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। ইতোমধ্যে যাদের ধরা হয়েছে তারাও জনপ্রতিনিধিদের নাম বলেননি। তবে সবগুলো অভিযোগ তদন্ত করছি আমরা। তদন্তে যদি কোনও জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় তখন আইনি ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।’
পাঠকের মতামত: