‘প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন’ ওই ভূমি সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপনের জন্য ২০২১ সালে ইজারা দেওয়া হয়েছিল।
কক্সবাজারের ‘রক্ষিত বনের’ জমিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নামের ওই একাডেমি গড়ে তুলতে ২০২১ সালে ৭০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন।
বরাদ্দ বাতিলের ব্যাপারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফকে চিঠি দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ওই বরাদ্দ বাতিলের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি চলতি মাসের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। জানা গেছে, বনভূমির ওই অংশ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তা বনভূমি হিসেবে রক্ষা করার ব্যাপারে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারের অন্যতম সমৃদ্ধ ওই বনভূমি সুরক্ষা করে যাতে একটি উদাহরণ তৈরি করা যায়, সে ব্যপারে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।
জানতে চাইলে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য যে পরিমাণে বনভূমি দরকার, তা নেই। ফলে যতটুকু বনভূমি টিকে আছে, তা রক্ষা করতে সরকার সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আশা করছি, কক্সবাজারের ওই ৭০০ একর রক্ষিত বনভূমি রক্ষা করে ওই অঞ্চলের প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারব।’
২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘কক্সবাজারের ৭০০ একর বনভূমি প্রশাসন একাডেমির নামে বরাদ্দ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ওই বরাদ্দের প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ২০২১ সালের ৩ জুলাই জমিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বন আইন ১৯২৭–এর ২৯ ধারা অনুযায়ী ওই এলাকাকে ১৯৩৫ সালে রক্ষিত বা প্রটেকটেড ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
বনভূমি–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ওই বনভূমিতে মূলত প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা রয়েছে। বন্য প্রাণীদের অন্যতম নিরাপদ আবাসও ওই এলাকা। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যতম মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী এশীয় বন্য হাতির একটি দল নিয়মিতভাবে ওই অঞ্চল দিয়ে বিচরণ করে। বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন নরম মাটি, ছড়া ও মিঠাপানির আধার ও সমুদ্র উপকূলবর্তী আবহাওয়ার কারণে সেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ বৃক্ষরাজি জন্মেছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ১৯৯৯ সালে ওই ঝিলংজা মৌজার বনভূমিসহ কক্সবাজার সদর ও সাগরসৈকতকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন–২০১০ অনুসারে ইসিএ এলাকায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, প্রতিবেশ–পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো তৎপরতা চালানো নিষেধ। কিন্তু ২০২১ সালে ওই বনভূমিকে খাসজমি দেখিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তা প্রশাসন একাডেমি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দপত্রে দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বনভূমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়। তারা জমির মূল্য ধরেছে ৪ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একাডেমির জন্য প্রতীকী মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় এলাকাটিকে অকৃষি খাসজমি দেখালে বন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়ে আপত্তি তোলে বন বিভাগ। ২০০১ সালে দেশের বনভূমির যে তালিকা করা হয়, তাতেও ঝিলংজা মৌজা বনভূমি হিসেবে আছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের ওই রক্ষিত বনভূমির বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত বাতিলের উদ্যোগ খুবই ইতিবাচক। একই সঙ্গে ওই এলাকায় এ ধরনের যেসব বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। শুধু বাতিল করে বসে থাকলে হবে না, ওই বনভূমি সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে।
পাঠকের মতামত: