কক্সবাজার, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

উখিয়ায় বাড়ছে অপরাধ, দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের

নিজস্ব প্রতিবেদক::

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মতো ভূমিকার মধ্যেই উখিয়া উপজেলাজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেশকিছু ছিনতাইচক্র। দিন দিন ছিনতাইয়ের আতঙ্ক বেড়ে চলছে জনমনে। চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে। ঝুঁকি নিয়ে রাতবিরেতে চলাচল করতে হচ্ছে ব্যবসায়ী, কর্মজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঠামো। প্রশাসন-পর্যায়ের এ দুর্বলতার সুযোগে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গজেছে কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইচক্র। প্রতিনিয়ত নানান অপরাধ-কর্মকা- সংঘটিত করে চলছেন চক্রের সদস্যরা।

সম্প্রতি উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত শনিবার ভোরের অন্ধকারে কর্মস্থলে বেরোনোর পথে মো. মাসুদ (৩৫) নামের এক ব্যক্তি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রুমখাঁ চৌধুরীপাড়া রাস্তার মাথার দক্ষিণে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল আরোহী তিনজন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি।

এসময় তাকে ছুরিকাঘাত করে মুঠোফোন-মানিব্যাগসহ সঙ্গে থাকা তার বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস ছিনতাইকারীরা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যান। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হলে পরে জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ভুক্তভোগী মাসুদ উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ক্লাশপাড়ার বাসিন্দা শাহ আলমের ছেলে।

গত ৭ অক্টোবর উখিয়া সদরে বড়ুয়া বাড়িতে জায়গা দখল করে গিয়ে হামলার শিখার হয়েছে বড়ুয়া পরিবারের ৩ সদস্য৷ পরে পুলিশে খবর দিলে তাঁরা পুলিশ আসতে আসতে অপরাধীরা পালিয়ে যায়৷ এতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে ওই পরিবার৷ থানা অভিযোগ করেও মিলেনি সুস্থ সমাধান।

গত ৬ অক্টোবর উখিয়া জালিয়াপালং পূর্ব পাইন্যাশিয়া, বড়ুয়াপাড়া এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জেরে হামলা ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে একই এলাকার ক্ষেহমোহন বড়ুয়ার ছেলে আনচ্ছ বড়ুয়া কালু, আনচ্ছ বড়ুয়া কালু এর ছেলে শান্ত বড়ুয়া তুনু, আনচ্ছ বড়ুয়া কালুর ছেলে  সাগর বড়ুয়া, মনিন্দ্র বড়ুয়া এর ছেলে দুলাল বড়ুয়া, পুইক্কা বড়ুয়া এর মেয়ে মিনু বড়ুয়া, বাদল বড়ুয়া মেয়ে প্রীতি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে।

এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী স্টেশনের মিজানুর রহমান নামের এক বিকাশ ব্যবসায়ী বাড়ি যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। জানা যায়, অন্ধকারের মধ্যে ওতপেতে থাকা কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য ব্যবসায়ী মিজানকে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে তার কাছে থাকা টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ব্যবসায়ী মিজানকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এ সময় গ্যাংয়ের এক সদস্যকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়।

সূত্র বলছে, সাধারণত মানুষের আনাগোনা নেই এমন নির্জন এলাকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকেন চক্রের সদস্যরা। পরে সুযোগ বুঝেই ছিনতাই শুরু করেন; একটু এদিক-ওদিক হলেই রক্তপাত। সাম্প্রতিককালে উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে এমন বেশকিছু ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত ও ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা সক্রিয় থাকেন।

সূত্রমতে, উখিয়ার কুতুপালং প্রধান সড়কের আমগাছতলা, টিভি টাওয়ার-সংলগ্ন এলাকা; ক্রাইমজোন খ্যাত পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট কাস্টম, বালুখালী পোস্ট অফিস এলাকা, মরাগাছতলা, হাকিমপাড়া, শফিউল্লাহকাটা ও গয়ালমরা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে ছিনতাইয়ের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এসব স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ছিনতাইকবলিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করছে সচেতন মহল।

খবর রয়েছে, বর্ণিত এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বালুখালী এলাকার স্থানীয় যুবকদের গড়ে তোলা কয়েকটি ছিনতাইচক্র। সাধারণ যাত্রী, স্থানীয় ও রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন স্মার্টফোন, গয়নাসহ মূল্যবান জিনিস। ক্ষেত্রবিশেষে চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গারাও জড়িত থাকেন বলে জানা যায়।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার একাধিক চালক জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর উঠতি বয়সী কিছু যুবক প্রধান সড়কে ছুরি, লোহা নিয়ে ছিনতাই করেন। কখনো যাত্রীর ছদ্মবেশে তারা গাড়িতে ওঠেন, কখনোবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছদ্মবেশে ব্যারিকেড সৃষ্টি করেন। তারপর জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেন নিরুপায় যাত্রীর।

চালকেরা জানান, রাত ১১টার পর আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে সড়ক। অনেক সময়, সুনসান সড়কে বিপদগ্রস্ত যাত্রীর ভাব ধরে প্রথমে কয়েকজন গাড়ি থামানোর সংকেত দেন; পরে গ্রুপের বাকি সদস্যরা এসে ছিনতাই শুরু করেন।

রাতের বেলা কর্মস্থল থেকে বাড়িফেরা যাত্রীরা আতঙ্ক থাকেন জানিয়ে বলেন, আজকে সে, কালকে ও; কোন দিন নিজেই ছিনতাইয়ের শিকার হই জানি না।

গত কয়েক মাসে কুতুপালং থেকে শুরু করে পালংখালী পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনিও খেয়েছেন ছিনতাইকারীরা।

সচেতন মহল বলছে, কমিউনিটি পুলিশ, গ্রাম পুলিশ ও থানা-পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে এসব চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চিহ্নিত এলাকাগুলোতে পুলিশি টহল জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে মহলটি।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, সমুদ্রতীরবর্তী ইউনিয়ন জালিয়াপালং, রত্নাপালং, রাজাপালং ও হলদিয়াপালংয়ের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের দ্বারা ছিনতাইসহ নানান অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে চুরিচামারির অভিযোগও উঠছে। কিন্তু যে সংখ্যক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, সেই সংখ্যক অভিযোগ থানায় দায়ের হচ্ছে না।

এ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে ও জানাতে যোগাযোগের চেষ্টা করলে উখিয়া থানা (ওসি) তদন্ত শফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলার কোথাও এধরণের ঘটনার খবর পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তবে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তানভীর হোসেন জানিয়েছেন, সম্প্রতি সংঘটিত কোনো ছিনতাইয়ের খবর তার নজরে আসেনি। ইউএনও বলেন, ছিনতাইচক্রের ব্যাপারে থানা-পুলিশকে অবহিত করা হবে। চক্রের দৌরাত্ম্য কমাতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশি টহল জোরদার করা হবে।

সম্প্রতিক উখিয়া প্রেসক্লাবে র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক এইচ.এম সাজ্জাদ হোসাইন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ের ওপর মতবিনিময় সভায় ছিনতাইচক্রের বিষয়টি তুলে ধরেন একাধিক গণমাধ্যম কর্মী। জবাবে চিহ্নিত এলাকাগুলোতে টহল জোরদার এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

পাঠকের মতামত: