কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ক্যাবিস বা চর্ম (খোসপাঁচড়া) রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আনুমানিক ৪০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। কিছু কিছু ক্যাম্পে আক্রান্তের হার ৭০ শতাংশেরও বেশি। এমতাবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)—সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল।
এমএসএফের মতে, এ প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্যাম্পে বিদ্যমান পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থার উন্নয়নকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এমএসএফ বলছে, স্ক্যাবিসের চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি সহজ। তবে সময়মতো চিকিৎসাসেবা না পেলে এটি মানুষের মাঝে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে রোগীদের ত্বক, জামা-কাপড় ও ঘরে কিছু ঔষধ প্রয়োগ করা; যা স্ক্যাবিসের পরজীবীগুলোকে নির্মূল করতে পারে। এ পরজীবীগুলোই সংক্রমণের মূল কারণ। তবে এমএসএফ সতর্ক করেছে যে এ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে শুধু ঔষধ যথেষ্ট হবে না, বরং প্রয়োজনে প্রাদুর্ভাবের উৎস নির্মূল করতে হবে।
বাংলাদেশে এমএসএফের মিশনপ্রধান কার্স্টেন নোকো বলেন, ‘বর্তমান প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ক্যাম্পে যথাযথ ঔষধের ব্যাপক বিতরণ সম্পর্কে বারবার আলোচনা করা হয়েছে, তবে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের যে মূল কারণ—জনবহুল ক্যাম্পের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, তা মোকাবিলার ব্যবস্থা না নিলে শুধু ঔষধ এ রোগের সংক্রমণ রোধ করতে পারবে না।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমএসএফ টিম ক্রমবর্ধমানসংখ্যক ত্বকের নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে যখন ক্যাম্পে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছিল, তখন থেকেই এমএসএফ উচ্চসংখ্যক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেছে। এ বছরের (২০২৩) জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ক্যাম্পে এমএসএফ টিম প্রায় ৭০ হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে এমএসএফের ডেপুটি মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. পঙ্কজ পাল বলেন, ‘চিকিৎসা দিতে গিয়ে কিছু কিছু দিন আমরা দিনে প্রায় ৭০০ রোগী দেখেছি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই ছিল এবং এই ক্রমবর্ধমান রোগী সামাল দেওয়ার বিশাল কাজের চাপ সামলেও আমরা বারবার সতর্ক করেছি। এই উচ্চসংখ্যক রোগী সামাল দিতে গিয়ে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে রোগীদের নিজ নিজ ক্যাম্পের কাছাকাছি থাকা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা নিতে বলার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। এই মুহূর্তে স্ক্যাবিসের জন্য চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগীকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছি না, আমাদের সে সক্ষমতা নেই।’
ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য আজমত উল্লাহ বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আমাদের চার বছরের ছেলের স্ক্যাবিস হয়েছে। তার হাতে ও পরে তার পুরো শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। আমরা ডাক্তার ও ফার্মেসির পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করেছি। অবশেষে আমার ছেলে সুস্থ হয়েছিল, তবে সে খুব দ্রুত আবারও স্ক্যাবিসে সংক্রমিত হয়। সে খুব একটা ঘুমাতে পারে না রাতে, তার পুরো শরীর চুলকায় এবং সে ব্যথায় অনেক কাঁদে। আমার বাকি দুই ছেলেরও স্ক্যাবিস এবং আমার ও আমার স্ত্রীর মধ্যেও লক্ষণ রয়েছে। এটা আমার পরিবারের জন্য একটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।’
বাংলাদেশে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স গত বছর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে; যা থেকে দেখা যায়, ক্যাম্পের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। সেখানে যথাযথ স্যানিটেশনের অভাব এবং পর্যাপ্ত পানির স্বল্পতা রয়েছে।
জামতলী ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছর বয়সি শরণার্থী তাহের বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আমি স্বাস্থ্যবিধির মান বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু এটা মেনে চলাও বেশ কঠিন। আমরা একই বিছানা, জামা-কাপড় এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য সব জিনিস অন্যের সঙ্গে ভাগ করে ব্যবহার করি। এখন আমরা স্ক্যাবিসের ক্ষেত্রেও তাই করছি।’
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খোসপাঁচড়ার প্রাদুর্ভাব এমন একটি সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যখন তাদের জন্য বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে খাদ্য রেশনিংয়ের পরিমাণ।
বাংলাদেশে এমএসএফের মিশনপ্রধান বলেন, ‘খোসপাঁচড়ার ৪০ শতাংশ হার একটি সতর্কবার্তা, যা আমাদের জানায় যে ক্যাম্পের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ঠিক নেই। এটি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণকল্পে আরও হুমকি বা ঝুঁকি তৈরি করছে।
পাঠকের মতামত: