কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫

প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন ফরিদা আখতার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নিরাপদ কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। দেশের সার্বিক খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের প্রতিবন্ধকতা, সম্ভাবনা এবং উত্তরণের নানা উপায় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

সার্বিক কৃষি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

দেশের একটি বড় অংশ কৃষি খাত, বিশেষ করে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং বনজ সম্পদ খাতে নিয়োজিত রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) একটি বড় অংশ সরবরাহ করছে এই সার্বিক কৃষি খাত। এর মধ্যে নিরাপদ আমিষের সরবরাহ করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। আবার দেশের রপ্তানি আয়ের একটি অংশের সরবরাহ হচ্ছে এই খাতের মাধ্যমে।

ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবেনানাভাবে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত জড়িত। এই খাতের উৎপাদন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, মাটি ও পানি ছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই এ খাতে অগ্রগতি হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য ও আমিষের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত বড় অবদান রাখছে।

দেশের কৃষি এবং প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য উৎপাদনের তথ্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

দেশের পুরো পরিসংখ্যান বিষয়ে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত সরকার দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। সেখানে এই বিবিএসও বাদ যায়নি। তথ্য নিয়ে আগের সরকার এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।

বিবিএস রাজনৈতিক কারণে তথ্য দিয়েছে। তাদের তথ্য অতিরঞ্জিত ছিল। ওইসব তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে নেওয়া প্রয়োজন। বিবিএসের তথ্য গরমিলের বিষয়টি শুধু কৃষি, মৎস্য ও প্রাণি খাতে রয়েছে তা নয়, এই প্রতিষ্ঠানের সব ক্ষেত্রেই তথ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য নির্ভরযোগ্য হয় কি না সেটি দেখা যেতে পারে।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তথ্য প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য আমরা চেষ্টা করছি মাঠ পর্যায়ের সঠিক তথ্য দিয়ে নীতি নির্ধারণ করতে। এখন সব তথ্যই যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হচ্ছে। ফলে আস্থাহীনতা যেমন কমে আসবে, তেমনি নীতি গ্রহণ আরো সহজ হবে।

সাধারণ মানুষের নিরাপদ খাবার খাওয়া কি অধরাই রয়ে যাবে?

দেশের সব ধরনের খাবারেই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। কয়েক দশক ধরে শুধু খাদ্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোয় নজর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মানসম্পন্ন উৎপাদনে ততটা নজর দেওয়া হয়নি। সব সময়ই পরিমাণগত উৎপাদনে জোর দিতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করেছি, কিংবা সেই খাবার আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না সেগুলো সঠিকভাবে দেখা হয়নি। আবার জীনগত পরিবর্তন করে খাবারের বিশুদ্ধতা ধ্বংস করা হচ্ছে। পরিবেশের ওপর অত্যাচার করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বিষাক্ত খাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে উৎপন্ন খাদ্য ও আমিষপণ্য, বিশেষ করে মাছ, পোলট্রি ও মাংস খাতে ফিড নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এর নিরাপদ উৎপাদন নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে কি না সেটি দেখা প্রয়োজন। এসব পণ্য মানুষের কাছে সহজলভ্য করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে নদীকেন্দ্রিক জলাধার থাকলেও তা মাছ উৎপাদনে সফলভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, নদীদূষণের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। ফলে এখানে আন্ত মন্ত্রণালয়ের অনেক বিষয় রয়েছে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করব।

আপনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে বিষমুক্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে আন্দোলন করছেন, কিন্তু এখনো সেটি থামছে না। সরকারের দায়িত্বে এসে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছেন?

কীটনাশক ও বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করা হচ্ছে, পাশাপাশি ক্ষতিকর পোকা দমনে কীটনাশকের ব্যবহার করতে গিয়ে উপকারী পোকা ধ্বংস করা হচ্ছে। নদীনালা কিংবা প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করেই খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবেজলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীটনাশকের মারাত্মক ক্ষতিকারক সূক্ষ্ম উপাদানগুলো দেহে প্রবেশ করছে, প্রাণঘাতী ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদভাবে কীটনাশক প্রয়োগের মাধমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কৃষক। বালাইনাশক আইনের কার্যকর প্রয়োগ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এমন বালাইনাশক বিক্রি, মিথ্যা তথ্যে বালাইনাশকের প্রচার বন্ধ করা প্রয়োজন।

পাঠকের মতামত: