কক্সবাজার, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

জীবনী ও জীবনের শিক্ষা : মহানবী সা:

বর্তমান বিশ্ব ও নবীজী সা:
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানরা বিবিধ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। রাজনৈতিক তথা অস্তিত্বের সঙ্কটে আছে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন, কাশ্মির ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলমানরা। শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। আদর্শিক সঙ্কটে আছে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র। পাশ্চাত্যের সেকুলারিজম (যার সাধারণ বাংলা অনুবাদ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা) মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কোনো সমাজে বেশি, কোনো সমাজে কম। আবার এটাও সত্য, অন্য যেকোনো ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুততম। অন্য ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হচ্ছেন এক বিশাল জনগোষ্ঠী এবং তারা শিক্ষিত। ভার্চুয়াল তথা ইন্টারনেট জগতের যোগাযোগব্যবস্থা বৃদ্ধির কারণে বা শক্তিশালী হওয়ার কারণে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও প্রচার সহজতর হয়েছে। এ কথা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে প্রযোজ্য, রাসূল সা:-এর জীবন সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এই প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; আমরা চাই তারা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। তাই উৎসাহমূলক ও প্রেরণামূলকভাবেই আজকের কলামটি লেখা।

দিবসটির তাৎপর্য
আজ বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ এবং বাংলাদেশের হিজরি ক্যালেন্ডার মোতাবেক রবিউল আউয়াল মাসের ১৫ তারিখ ১৪৪১ হিজরি। মাত্র তিন দিন আগের তারিখ বা দিনটি ছিল রোববার, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:-এর দিন। কোনো কোনো পত্রিকা বা আলোচক এটাকে নবী সা: দিবস বা সিরাতুন্নবী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মূল কথা হলো, দিনটি ছিল নবীজী সা:-এর এই পৃথিবীতে আগমন দিবস তথা আমাদের ভাষায় জন্মদিন। ঘটনাক্রমে, এ বছরের ঈদে মিলাদুন্নবী সা:-এর আগের দিন তথা শনিবারের দিনটি ও শনিবার দিবাগত রাতটি ছিল দুর্যোগের দিন-রাত এবং ‘বুলবুল’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৈরী আবহাওয়ার দিন। তার পরও বাংলাদেশে নবীপ্রেমিক মুসলমানরা এ দিবসটি তথা এ দিবসের কয়েক দিন আগ থেকেই দিবসটি পালন করা শুরু করেছিলেন। বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও বহু স্থানে জাঁকজমকের সাথে ও গঠনমূলকভাবে দিবসটি পালিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল নিজেদের উদ্যোগে, মিলাদ শরিফ পড়ায় ও সেটি প্রচার করে। একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে সময় নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে অথবা হামদ ও নাত পরিবেশন করে, বিশেষত মহানবী সা:কে নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক রচিত ইসলামী সঙ্গীতগুলো পরিবেশিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় ছোট বা বড় আকারে সংবাদ বের হয়েছে, কলাম ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু দিবসটি তথা রোববার ১০ নভেম্বর সরকারি ছুটির দিন ছিল, তাই সোমবার ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে কোনো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয়নি। অতীতে আমরা যখন শিশু বা কিশোর ছিলাম তখন স্কুলে আলোচনা সভা হতো, মিলাদ শরিফ হতো এবং মিষ্টি বিতরণ হতো। যা হোক, একজন অভ্যাসকারী মুসলমান হিসেবে আমি মনে করি, এ দিনটি পালন করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো দিনটির তাৎপর্য বোঝা। এই দিনে জন্মগ্রহণকারী বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয়তম বন্ধু, সর্বশেষ রাসূল ও নবী এবং রাসূল ও নবীগণের ইমাম হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের শিক্ষাগুলো নিয়ে চিন্তা করা।

মতবিনিময় গুরুত্বপূর্ণ
গত ৭ নভেম্বর ২০১৯ ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা কলাম প্রকাশিত হয়েছে; নয়া দিগন্তেও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমি ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে আমার লেখাটি বুধবার ৬ নভেম্বর তারিখেই লিখে দিয়েছিলাম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। উদ্দেশ্য ছিল ৬ নভেম্বর যদি আমার কলাম কেউ পড়েন এবং যারা পড়লেন তাদের মধ্যে যদি কেউ চিন্তা করেন, তাহলে সেই চিন্তাকারী (বা চিন্তাশীল ব্যক্তি) ৭ তারিখ সম্বন্ধে নিজের মনের ভেতরে একটি ধারণা গঠন করার জন্য এক দিন সময় পেলেন। আমার মনের ভেতরে একই প্রকার চিন্তা ১২ রবিউল আউয়াল নিয়ে কাজ করলেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমি মনে রাখি এবং সম্মানিত পাঠকদের মনে রাখতে আহ্বান জানাব যে, ১২ রবিউল আউয়ালের আবেদন বা ওই তারিখের শিক্ষাগুলোর মর্ম শুধু ওই দিনে তোতাপাখির মতো উচ্চারণের জন্য নয়; বরং সর্বজনীন সার্বক্ষণিক। অতএব, দিনটি গত হয়ে গেলেও পাঠক আমার এই কলামের মর্ম নিয়ে আগামীতে চিন্তা করার সুযোগ পাবেন। আমার আবেদন, যেই পাঠকের দ্বারাই সম্ভব, যতটুকু সম্ভব, চিন্তা করুন। চিন্তার বিষয় কী? বিষয় হলো মহানবী সা:-এর জীবনী, তাঁর কর্মগুলো যথা পারিবারিক জীবন, মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের উন্মেষ ও রাষ্ট্রনায়কের জীবন, সেনাপতির জীবন, নৈমিত্তিক ইবাদতের জীবন ও যতটুকু দর্শনীয় ততটুকুই আধ্যাত্মিকতার জীবন ইত্যাদি।

কেন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব?
মহানবী সা:-এর জীবনী নিয়ে বহু পুস্তক লেখক বা কলাম লেখক বা প্রবন্ধকারকেই দেখেছি একটি পুস্তকের রেফারেন্স দিতে। পুস্তকটির নাম ‘দি হান্ড্রেড : এ র‌্যাংকিং অব দি মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসনস ইন হিস্ট্রি’। এই বইয়ের লেখক পাশ্চাত্যের একজন অমুসলমান পণ্ডিত, যার নাম মাইকেল এইচ হার্ট। মাইকেল হার্ট পৃথিবীর ইতিহাসে বা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বা সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন ব্যক্তিত্বের তালিকা ও জীবনী প্রকাশ করেছেন তার বইয়ে। মাইকেল হার্টের মতে এবং তার বইয়ে প্রকাশিত তালিকা মোতাবেক, এই ১০০ জনের মধ্যে ক্রমিক নম্বর ১ হচ্ছেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: তথা মাইকেল হার্টের ভাষায়- মুহাম্মদ সা: হচ্ছেন মানব সভ্যতার ওপর, মানব ইতিহাসের ওপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব। অতএব, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি মাইকেল হার্ট জানতেন, তার এই বিবেচনা বা সিদ্ধান্ত ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তাই তিনি মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী নিয়ে যেই অধ্যায় তার পুস্তকের শুরুতেই আছে, সেই অধ্যায়ের শুরুতেই এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যাটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর মর্ম ব্যাপক।

মাইকেল হার্টের ব্যাখ্যা
মাইকেল হার্ট লিখেছেন, ‘ইতিহাসে মুহাম্মদই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় অঙ্গনে এবং জাগতিক অঙ্গনে তথা উভয় ক্ষেত্রে চরমভাবে সফল হয়েছিলেন। বাকি ৯৯ জনের মধ্যে বেশির ভাগই কোনো-না-কোনো সভ্যতার কেন্দ্রে বা জনপদে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং উৎসাহব্যঞ্জক বা জ্ঞানবান্ধব পরিবেশে বড় হয়েছেন। কিন্তু ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মুহাম্মদ আরব উপদ্বীপের মক্কা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন চতুর্দিকের জনপদগুলো, ওই জনপদগুলোতে লেখাপড়ার স্তর এবং তাদের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার স্তর তৎকালীন পৃথিবীর পরিচিত মানদণ্ডে অনেক নিম্নস্তরে ছিল। সেইরূপ নিম্নস্তরে থেকেও মুহাম্মদ সা: একটি নতুন চিন্তা, নতুন চেতনা, নতুন সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।’ আমি মাইকেল হার্টের সিদ্ধান্তের কারণেই মুহাম্মদ সা:কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলব না; বরং আমার নিজের করা বিশ্লেষণ ও আমার নিজের বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তেই আমি তাঁকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলব।

সঠিক জ্ঞান অর্জন কেন প্রয়োজন?
ভাঙন সৃষ্টি করা বা ভেঙে দেয়া সহজ, জোড়া লাগানো বা গঠন করা কঠিন। সমালোচনা করা খুব সহজ, সমালোচনার উত্তর দেয়া কঠিন। সমালোচনা করা খুব সহজ কেন? এ জন্যই সহজ কারণ, গুজবের ওপর ভিত্তি করে, কানকথার ওপর ভিত্তি করে, চটকদার সংবাদ পড়ে, ভিত্তিহীন রচনা পড়ে যেই হালকা জ্ঞান অর্জন করা হয়; সেই হালকা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই সমালোচনা করা যায়। কিন্তু সমালোচনার উত্তর দিতে গেলে গভীর এবং ব্যাপক লেখাপড়া করতে হবে, সুপ্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতের সুপরিচিত লেখা পড়তে হবে এবং যেকোনো তথ্যের বা মতামতের গোড়ায় যেতে হবে। এ কথাটি সাম্প্রতিক এক দশকের ফেসবুকের রচনাবলির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি দেড় হাজার বছরের পুরনো দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, শুধু আজকে বলে নয়, গতকাল এবং গত পরশু তথা গত দশক বা গত শতাব্দী বা তার আগেও একটি প্রবণতা যেমন ছিল, সেই একই প্রবণতা আজো আংশিকভাবে আছে। প্রবণতা কী? প্রবণতা হলো, সাধারণভাবে মুসলিম তরুণ-তরুণী কর্তৃক লেখাপড়া থেকে দূরে থাকা, গবেষণা থেকে দূরে থাকা, কানকথা ও গুজবের ওপর নির্ভর করা, দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে লেখাপড়াকে পশ্চাৎমুখিতা মনে করা এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী পড়াকে অনুৎপাদনশীল শ্রম মনে করা। এই প্রবণতার কারণে মুসলমান সমাজের তরুণ-তরুণীরা সাধারণভাবে, অর্থাৎ ব্যতিক্রম ব্যতীত সাধারণেরা, যেকোনো বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান থেকে দূরে থাকে।

রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী
আমার ঈমানে প্রথম বা আদি বা শিকড় যেই বাক্যে এবং যেই অনুভূতিতে নিহিত, সেখানে দু’টি শব্দ বা নাম পাশাপাশি অবস্থিত, একটি শব্দ বা নাম ‘আল্লাহ’ এবং অপর শব্দ বা নাম ‘মুহাম্মদ’। তাই মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ যে দ্বীন বা যে জীবনবিধান পৃথিবীতে আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে চিন্তা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে এবং আমার জন্য উপকারী তো বটেই। অনুরূপ যার মাধ্যমে সেই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন এ পৃথিবীতে এসেছে, তাঁর সম্বন্ধে জানাও আমার কর্তব্য ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং জানাটা আমার জন্যও উপকারী। আমি মনে করি, দ্বীন সম্বন্ধে এবং রাসূল সম্বন্ধে না জানা বড় রকমের অপরাধ ও ক্ষতিকারক। এই দুনিয়ায় তথা এই পার্থিব সংসারে যেই ব্যক্তি যত বড় পোস্ট অলঙ্কৃত করেছেন, যত বড় দায়িত্ব পালন করেছেন, যত বেশি ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন, যত বেশি সুনাম অর্জন করেছেন, এই সবগুলো প্রসঙ্গে একজন বিশ্বাসীর দৃষ্টিতে বলতে চাই, তিনি ওই পরিমাণ বেশি বেশি আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়াপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাহলে যিনি যত বেশি দয়া পেয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশও তত বেশিই হতে হবে, এটাই স্বাভাবিক সূত্র। অতএব, যেসব মুসলমান ভাইবোন লেখাপড়া জানেন, তাদের পক্ষে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যে, তারা মহানবী সা:-এর জীবনী পড়বেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন। যেসব মুসলমান ভাইবোন আল্লাহর প্রেমে ডুব দিতে চান, নবীর প্রেমে ডুব দিতে চান, তাদের জন্য এটা অত্যন্ত সহায়ক কর্ম যে, তারা মহানবী সা:-এর জীবনী পড়বেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন। এই সঙ্ঘাত-সঙ্কুল একবিংশ শতাব্দীতে, পৃথিবীর চারটি প্রধান উপমহাদেশে বিপদগ্রস্ত মুসলমানদের বিপদসঙ্কুল পরিবেশ সম্বন্ধে যদি গভীর ধারণা পেতে হয়, তাহলে যেকোনো আগ্রহী ব্যক্তির জন্য এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি কাজ যে, তিনি মহানবী সা:-এর জীবনী পড়বেন এবং বুঝতে চেষ্টা করবেন। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, মহানবী সা:-এর ইন্তেকালের পর, একদিন একজন সাহাবি উপস্থিত হলেন মহানবী সা:-এর স্ত্রী তথা মুসলমানদের মা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা:-এর সামনে। সম্মানিত সাহাবি বিনীত আবেদন করলেন : ‘আমাদেরকে রাসূল সা:-এর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলুন।’ মা আয়েশা সিদ্দিকা রা: উত্তর দিলেন : ‘আপনি কি কুরআন পড়েননি? পবিত্র কুরআনই তো তাঁর অনুপম চরিত্র।’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের আলোকেই রাসূলুল্লাহ সা: তথা নবীজীর পবিত্র জীবন গঠিত। পবিত্র কুরআনে, তাঁর প্রিয় বন্ধু রাসূল সা:কে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ‘আপনি তো মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনের পাঠক এবং বিশ্বাসীদের সামনে নবীজী সা:-এর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এভাবে : ‘তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা উদ্বিগ্ন করে সেগুলো তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র এবং পরম দয়ালু।’ অনুসন্ধিৎসু বা অনুসন্ধানী মনসম্পন্ন যেকোনো সচেতন মুসলমানেরই জানতে চাওয়ার কথা, স্বাভাবিক যুক্তিতে, কী কারণে বা কী যুক্তিতে বা কী প্রেক্ষাপটে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু সম্বন্ধে এসব বাক্য উপস্থাপন করেছিলেন। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করুন, আমি পূর্ববর্তী বাক্যে লিখেছি দু’টি শব্দ : স্বাভাবিক যুক্তিতে। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বে মুসলমানদের সামনে স্বাভাবিক যুক্তিগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সহনীয় বিষয়গুলোকে অসহনীয় হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সুন্দর সুস্মিত বিষয়গুলোকে অসুন্দর ও কঠোর হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কে করছে? পাশ্চাত্য বিশ্ব; বন্ধুবেশী শত্রুরা এবং অল্প বিদ্যায় আপ্লুত অহঙ্কারী মুসলমানরা। আমি নিজে প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে বা আমাদেরকে সঠিক উপস্থাপনার সম্মুখীন করেন।

বইপুস্তকের বিশাল ভাণ্ডার
রাসূলুল্লাহ সা: তথা নবীজীর জীবনী বা তাঁর জীবনের কর্ম সম্বন্ধে জানার জন্য সুযোগের কোনো অভাব নেই। বইপুস্তকের অভাব নেই। যে ভাষায় মানুষের ইচ্ছা সেই ভাষাতেই যথেষ্ট বইপুস্তক এবং লেখাপড়ার উপাদান আছে। গত পাঁচ-ছয় দশকে বাংলা ভাষায় অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি কর্তৃক মহানবী সা:-এর জীবনী লেখা হয়েছে বা কর্মাবলির মূল্যায়নমূলক গ্রন্থ লেখা হয়েছে বা অন্যান্য ভাষা থেকে ওইরূপ পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম যুগপৎ প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো ইবনে হিশাম কর্তৃক লিখিত ‘সিরাত’। এ গ্রন্থটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি বাংলা ভাষায়ও অনুবাদ পুনঃপ্রকাশ করেছে ‘প্রথমা’ নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের ১২ জুলাই আমি বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ইসলামী বইমেলা থেকে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘মহানবীর জীবন চরিত’ নামক গ্রন্থটি সংগ্রহ করি। আলোচ্য বইটি হলো মিসরের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক ডক্টর মুহাম্মদ হোসাইন হায়কল কর্তৃক আরবি ভাষায় প্রণীত ‘হায়াতে মুহাম্মদ (সা:)’ নামক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ। আরবি থেকে বাংলার অনুবাদক হচ্ছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আব্দুল আউয়াল। আনুমানিক দেড় দশক আগে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সঙ্গীতশিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী কর্তৃক লিখিত জীবনী গ্রন্থ ‘মুহাম্মদ এর নাম’ আমার হস্তগত হয়েছিল। দেড়-দুই দশক আগে কোনো একসময়, রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী গ্রন্থ রচনার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত গ্রন্থ, নাম : আর রাহীকুল মাখতূম; এর বাংলা অনুবাদ করেছেন খাদিজা আখতার রেজায়ী; এটিও সহজলভ্য ও উপকারী পাঠ্য। বাকি আরো দুই ডজন বইয়ের নাম উপস্থাপন করছি না। ইন্টারনেট, মানুষের জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রশস্ত রাস্তা খুলে দিয়েছে। গুগল-এ মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে সার্চ দিলে বা জীবনী গ্রন্থসমূহ তালিকার প্রসঙ্গে সার্চ দিলে বিশাল তথ্যভাণ্ডার উপস্থিত হবে। আমি আশা করি, সম্মানিত পাঠকগণ যারা এখনো রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী পাঠ করেননি, তারা কোনো-না-কোনো জীবনী পাঠ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করবেন। জীবনী পাঠ করলে, অন্যান্য উপকারিতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকারিতা হলো, রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বলাই বাহুল্য, মহান আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে রাসূলুল্লাহ সা:কেও ভালোবাসতে হবে। আরেকটি উপকারিতা হলো, নিজের জীবনে রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনের শিক্ষাগুলোর কোনো-না-কোনো দিকে প্রয়োগের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com

পাঠকের মতামত: