কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ৯ ডিসেম্বর রাতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকধারীদের গোলাগুলিতে নিহত হন সলিম উল্লাহ ও রেদোয়ান নামের দুই রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার (আরাকান স্যালভেশন আর্মি) প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিকে দায়ী করা হয় এর জন্য। তাকে প্রধান আসামি করে ৩৩ জনের নাম উল্লেখসহ মামলা হয় উখিয়া থানায়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ৪০-৪৫ জনকে। এজাহারে বলা হয়েছে, মাদক কারবার নিয়ে আতাউল্লাহর সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী নবী হোসেন গ্রুপের দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে এই দুইজনকে হত্যা করা হয়। এজাহারে আতাউল্লাহর ঠিকানা উল্লেখ করা হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর কোনারপাড়া মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখা।
এর আগে ১৪ নভেম্বর তুমব্রু এলাকায় ডিজিএফআই ও র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানের সময় তাদের ওপর হামলা হয়। মাদক পাচারকারীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। সেই হামলায় এক ডিজিএফআই কর্মকর্তা নিহত হন। আহত হন এক র্যাব সদস্য। নিহত ডিজিএফআই কর্মকর্তা হচ্ছেন বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদি। আহত র্যাব সদস্যের নাম সোহেল বড়ুয়া। এ ঘটনায় গত ২৩ নভেম্বর কক্সবাজারে কর্মরত ডিজিএফআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় ৬৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম-ঠিকানা উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে। এর ১ নম্বর আসামি আরসার প্রধান আতাউল্লাহ।
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া ডি ব্লকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরদিন মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তভার পান উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন। তদন্ত শেষে ২৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ হত্যায় মিয়ানমারের কথিত সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা জড়িত বলে উল্লেখ করে আতাউল্লাহকে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী দাবি করা হয়। যদিও ঠিকানা নিশ্চিত না হওয়ায় আতাউল্লাহকে আসামির তালিকা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত সাত মাসে ৩০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের শিকার রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ ছিলেন ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছাসেবক।
এসব হত্যার জন্য ‘আরসা’ দায়ী বলে মনে করছেন নিহতদের স্বজনরা। কক্সবাজারে শরণার্থী হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের দাবি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি ও সাব-মাঝিদের মধ্যে এখন আরসা-আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, ক্যাম্পের ভেতরে দোকান থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা কারণে আরসা সদস্যরা মাঝিদের হত্যার ‘মিশনে’ নেমেছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রাখা হয়েছে। খুনখারাবি বেড়ে যাওয়ায় একটু আতঙ্ক থাকলেও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে হেড মাঝি ও সাব-মাঝির সংখ্যা আড়াই হাজার।
অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জানান, মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হন তিনি। মুহিবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা মেনে নিতে না পেরে রোহিঙ্গাদেরই একটি সশস্ত্র গ্রুপ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে। এরপর থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের উদ্যোগে বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একের পর এক খুন করে যাচ্ছে।
উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি, সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।
কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলছেন, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তা না মানার প্রবণতা তাদের রয়েছে। এ সুযোগকে কাজ লাগিয়ে নেতৃত্বশূন্য করার কোনো মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা ভিন্ন কোনো মহল করছে কিনা তা দেখা জরুরি। এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলছেন, বিভিন্ন অপরাধে ক্যাম্পের ঘটনায় যেসব মামলা হয় তা গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। প্রয়োজনে ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকেও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ক্যাম্পে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে।
পাঠকের মতামত: